গোপাল সিং, খোয়াই, ১৭ ফেব্রুয়ারী ।। ইদানিংকালে খোয়াই শহর ও শহরতলী ভবঘুরেদের আখড়ায় পরিনত হয়ে পড়েছে। শহরের উপকণ্ঠে ভঘুরেদের সংখ্যা কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভবঘুরেদের পূণর্বাসন কিংবা তাদের জন্য কিছু করার একটা মানসিকতার অভাব সর্বত্রই রয়েছে। সভ্য সমাজের বাইরে তাদের অন্য একটা অন্ধকার জগতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আইনও তাদের পক্ষে কথা বলছে না। যে কারনে পুলিশ বা প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে থাকে। তবে আইনের ফাঁকে কেউ নাক গলাতে রাজী নন। যে কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক সংস্থা চাইলেই ভবঘুরেদের জন্য কিছু করা সম্ভব। কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজে এদের জন্য ভাববার সময় কোথায়?
এমনই যখন পরিস্থিতি। খোয়াই শহরে আবির্ভাব ঘটে এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার। খুব বেশী বয়স্ক বলে মনে হচ্ছিল না। কোলে ছোট্ট অবোঝ শিশু। মহিলার বেশভূষা খুব বেশী বেমানান বা দৃষ্টিকটু নয়। কিন্তু বেশ কিছু দিন যাবত এই মা তার ছোট্ট কোলের শিশুটিকে বুকে আগলে খোয়াই শহরের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছিল। ঠিক ক’দিন যাবত মহিলা ও শিশু খোয়াইতে রয়েছেন তা হলফ করে বলা না গেলেও, এতটুকু জানা গেছে তাদের মাঝে মাঝে রাস্তার আনাচে-কানাচে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছিল মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা ও তার কোলের শিশুটি কি তবে ভুকা পেটে দিন গুজারা করছিল?
এমনই পরিস্থিতিতে স্থানীয় এক-দুজন মিডিয়া কর্মী গোটা বিষয়টি খোয়াই মহকুমা শাসকের গোচরে আনেন। মিডিয়া কর্মীরা ত্রিপুরা জার্ণালিষ্ট এসোসিয়েশন, খোয়াই জেলা কমিটির সদস্য। তাদের এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হল তা খোয়াই শহরের ব্যস্ত মানুষ স্বচক্ষেই দেখলেন। একটি মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা যখন কোলের শিশুকে নিয়ে খোয়াই শহর চষে বেড়াচ্ছিল, সবাই কেবল তামাশা দেখলেন। সেই মহিলা বা তার শিশুর পেটে দুমোঠো খাবার জুটল কিনা তার খোঁজ কেউই নিলেন না।
সে যাইহোক, বুধবার সকালে খোয়াই সুভাষপার্কেই স্থানীয় মহিলা পুলিশের একপ্রস্থ দৌড়ঝাঁপ ছিল কেবল মাত্র এক মহিলা ও তার শিশুকে নিয়ে। মহিলা পুলিশ নাজেহাল হয়ে পড়লেন এই দুজনকে পুলিশের ভ্যানে তুলতে গিয়েই। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন। আরেকজন সেই মায়ের অবোঝ সন্তান। শিশুকে কোলে নিয়ে মহিলা পুলিশ বসে রইলেন পুলিশী ভ্যানে, কিন্তু শিশুর মাকে সেই ভ্যানে তুলতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হল মহিলা পুলিশকে। বিষয়টি অনেকটা হাস্যকর হলেও ঘটনা সত্যি। দীর্ঘ সময় টানাপোরেনের পর অবশেষে মহিলাকে পুলিশের ভ্যানে তোলতে সক্ষম হয় পুলিশ। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে আশ্চর্জনকভাবে ঘটনার সময় উপস্থিত জনসাধারনের অসহযোগিতার একটা নগ্ন চেহারা কেমন যেন প্রকট হয়ে পড়ল এদিন। মহিলা পুলিশ যখন হ্যাস্ত-ন্যাস্ত হচ্ছিলেন, তখন সাধারন মানুষ তামাশা দেখতেই ব্যস্ত। কেউই এগিয়ে এসে সাহায্য করলেন না। সাহায্য করলেন না এতদিন রাস্তায় রাস্তায় একটি অবোঝ শিশুকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করা সেই মাকে। অবোঝ শিশুটির পেটে এতদিন ঠিকমতো যে খাবার পড়েনি তাতে কোন সন্দেহ নেই। শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে কেউই কিন্তু এগিয়ে আসেননি। তবে বুধবার মিডিয়া কর্মীদের দৌলতে মা ও শিশুর ভাগ্য এবার যে বদলাতে যাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের দুজনকেই হোমে পাঠানো হয়েছে। মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার মানসিক চিকিৎসা নিশ্চই হবে। মনে করা হচ্ছে সামান্য চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠতে পারেন। আর তাই শিশুটির জন্য সুখকর হবে। সে ফিরে পাবে সুস্থ্য মায়ের কোল, মায়ের পরশ, ভালবাসা। তবে একটা কথা নিশ্চিত যে এখন আর অবোঝ শিশুটিকে ক্ষুধার যন্ত্রনায় কষ্ট করতে হবে না।
তবে কিছুদিন পূর্বেই খোয়াই শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে এক ভবঘুরে যুবক ৯ বছর বাদে তার বাড়ী ফিরেছিল। ফিরে পেয়েছিল তার আপনজনকে। তাই আশায় পারদ কিন্তু এবার চড়ছে। সবারই প্রত্যাশা, মহিলা সুস্থ্য হয়ে উঠুক। অবোঝ শিশু তার মায়ের কোলে ফিরে পেলে আরও একটা ঘটনা ছাপার অক্ষরে লেখা থাকবে। আগামী দিনে ভবঘুরেদের জন্য এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবাইকে ইন্ধন যুগাবে।