গোপাল সিং, খোয়াই, ০৩ জুন ।। জন্মলগ্ন থেকে সব ধরনের, সব ভাষার চলচ্চিত্রেই আমরা দেখে আসছি প্রকাশ্য দিবালোকে সিনেমার ভিলেনরা কিভাবে নিরীহ মানুষকে খুন করে। আর সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখতে উপচে পড়া ভীড় কেবলই বাড়তে থাকে। কিন্তু অসংখ্য মানুষের ভীড় থেকে কেউই নিরীহ মানুষটিকে বাঁচাতে ভিলেন পার্টির সামনে আসতে চায়না। পাছে তাকেই না জীবন দিতে হয় এই ভয়ে। কিন্তু সিনেমায় একজন হিরো থাকেন, যিনি পরিস্থিতি এবং দর্শকের হাততালি কুড়িয়ে নেন কেবল মাত্র ভিলেনদের সাফাই করে। কিন্তু বাস্তবের হিরোরাই যদি দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখেন তবে যা হবার তাই হল খোয়াই মহারাজগঞ্জ বাজার স্থিত বাস স্ট্যান্ডে। নির্দয়ভাবে এক নিরীহ শ্রমিককে পুলিশের সামনেই পিটিয়ে খুন করা হল। অথচ ঘটনাস্থল থেকে খোয়াই থানার দূরত্ব পঞ্চাশ মিটারেরও কম। পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে কেবল তামশা দেখলেন। যারা চায়ের কাপে আড্ডায় মশগুল হয়ে মিডিয়া, পুলিশ, সরকার, দল নিয়ে বড় বড় ল্যাকচার ঝাড়েন। সেই জনগনই চার-পাঁচ জন দুস্কৃতিকারীর ভয়ে কুপোকাত হয়ে নিরীহ শ্রমিকের হত্যাকান্ডের লাইভ ট্যালিকাষ্ট দেখলেন।
দেখলেন চার-পাঁচ জন মিলে এক গরীব শ্রমিককে প্রকাশ্যে তিলে তিলে পিটিয়ে হত্যা করা হল। যারা হত্যা করল তারা কিন্তু পেশাদারি খুনি নন। এই খুনের জন্য শুধু চার-পাঁচ জনই দায়ী নয়, দায়ি পুলিশ কর্মী এবং প্রায় পঞ্চাশোর্ধ জনগন, যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানবতা বোধকে গিলে ফেললেন। অথচ মানবতাবোধ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কিংবা অসংখ্য জনসাধারন যদি প্রতিরোধ গড়তো তবে এভাবে চলে যেতে হতনা নিকুঞ্জ বর্মন নামে ঐ নিরীহ শ্রমিককে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পিতৃহারা হতনা মৃত নিকুঞ্জ বর্মনের পাঁচ মাসের শিশু, যে কিনা এখনও মায়ের গর্ভেই রয়েছে। ছেলের মৃত্যুর দিনই চক্ষু অপারেশন করা বৃদ্ধা মাকে এই অবস্থায় ছেলের লাশ বুকে নিয়ে অশ্রু ঝড়াতে হতনা। তিরিশ মিনিটে তছনছ হয়ে গেল একটি পরিবার। পাঁচ মাসের অন্ত:সত্বা স্ত্রী’র আকুতি গর্ভের সন্তান আর কোনদিন তার জন্মদাতা পিতাকে দেখতে পারবেনা। জন্মদাত্রী অসুস্থ্য মায়ের বিলাপ, চক্ষু অপারেশন করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে তিনি যে তার সন্তানকেই আর দেখতে পারবেন না।
বৃহস্পতিবার দিনটিতে খোয়াইজুড়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির দৌড়ঝাঁপ প্রত্যক্ষ করল মানুষ। কি হবে? থানায় ডাইরি হবে। আইনি লড়াই হবে। কিন্তু নুন আনতে পান্থা ফুরোয় অবস্থায় থাকা মৃত নিকুঞ্জ বর্মনের পরিবারের কি দীর্ঘদিন যাবত আইনি লড়াই জারী রাখতে পারবে? হয়তো আইনি লড়াইয়ে বেকসুর খালাস পাবে রক্ত পিপাসুরা। কিন্তু যদি বিবেক থাকে তবে এই নিরীহ শ্রমিককে যারা খুন করল, যারা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখলেন প্রতিদিন এই নৃশংস ঘটনা ঘুম কেড়ে নেবে তাদের। যারা ঘটনার নায়ক, উনারা সবাই প্রভাবশালী। কথায় আছে ‘তাওয়া গরম আছে, যে যেমন খুশি রুটি সেঁকে নাও’। কংগ্রেস-তৃনমুল কংগ্রেস-বিজেপি সহ অন্যান্য সংগঠন বা দল আসবে। গরীব পরিবারটির বাড়ীতে গিযে বড় বড় কথা বলবে। প্রতিশ্রুতি দেবে। ক্যামেরার সামনে নানাভাবে ছবি তোলা হবে। বিরাট আকারে প্রচার আসবে। উনারা উনাদের উপর মহলে জানান দেবেন, দেখুন আমি বা আমরা কেমন লড়াকু নেতা। সবই প্রচার আবার প্রতিবাদ করাও।
কিন্তু নুন আনতে পান্থা ফুরোয় অবস্থায় জীবন যাদের কাটে, সেই পরিবারটিকে নিকুঞ্জ বর্মনের মৃত্যুর পর কে দেখবে? বৃদ্ধা মা প্রায় তিরিশ বছর যাবত গৃহপরিচারিকার কাজ করে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে লালন পালন করেছেন। বড় ছেলে একটু ব্যতিক্রমি হওয়ায় কোন রকম চলেন। ছোট ছেলে ছিল ঠিক। কাজ করে সংসার দেখশুন করার দায়িত্ব নেয় নিকুঞ্জ বর্মনই। বৃদ্ধা মাকে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেও বারন করেছিলেন তিনিই। যদিও অভাবের সংসারে বাড়ী-ঘর একপ্রকার রুগ্ন অবস্থায়। বর্তমানে মৃত নিকুঞ্জ বর্মনের স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্ত:সত্বা। এখন এদের কে দেখবে? সংসার কিভাবে চলবে? অন্ধ মা আর স্ত্রী’র দিন কিভাবে যাবে? কোন দলই কিন্তু তার কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। রাজ্য সরকারের কাছেও এমন কোন দাবি রাখা হয়নি। সবাই এলেন ঠিকই, কিন্তু কেউ আড়াই, কেউ পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
শুক্রবারই মৃত নিকুঞ্জ বর্মনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হল। ধীরে ধীরে সব মলিন হয়ে আসবে। কয়েকদিন যাবত বাড়ীর সামনে কতই না ভীড়। মিডিয়া কর্মী থেকে জনগনের অপেক্ষা, এই বুঝি কোন ভিআইপি আসবে। হয়তো কোন জোড়ালো বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু আজকের দিনের পরই কে খোঁজ রাখবে এই নিরীহ পরিবারটির? কিভাবে চিকিৎসা হবে মৃত নিকুঞ্জ বর্মনের অন্ত:সত্বা স্ত্রীর? কিভাবে চলবে অভাবের সংসার? হয়তো কোন মিডিয়াও পা মারাবেনা সেদিকে। এই অবস্থার মধ্যে খোয়াইয়ের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অভিমত, আসুন না দলতম নির্বিশেষে এই নিরীহ পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করি। সমাজকে একটা বার্তা দিই।