গোপাল সিং, খোয়াই, ১৯ জুন ।। খোয়াই শহর অনেক ইতিহাস এর সাক্ষী। যার বর্ননা দেওয়া বা জানা খুবই দুর্লভ। ১০৬ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠছে আধুনিক খোয়াই। ১০ হাজার লোকসংখ্যা থেকে দেড় লক্ষ জনসংখ্যায় পৌছে যাওয়া খোয়াই, সংস্কৃতির শহরই শুধু নয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও ত্রিপুরার মানচিত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বুকে বয়ে চলছে। এ যেন ত্রিপুরার হৃদপিন্ড। আর এই শহরের উপর দিয়ে ক্রমাগত যাতায়াত করছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মানুষজন। খোয়াই শহর এবং শহরতলী এখন আর আগেকার চেহারায় নেই। যারা বিগত ১৫-২০ বছর বাদে খোয়াইতে পা রাখছেন তাদের মধ্যে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলছেন। কোথায় যাবেন, কোন দিকে যাবেন ভেবে কুল করতে পারেন না। খোয়াই শুধু রাজনীতির বদ্ধভূমি কিংবা সংস্কৃতির শহরই নয়, বর্তমানে পর্য্টন মানচিত্রেও খোয়াইয়ের নাম সর্বজনবিদিত। একে একে খোয়াই শহর সেজে উঠেছে। শহরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন মণীষী এবং মুণি-ঋষিদের আবক্ষ মূর্ত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের এই মহান মণীষীদের জীবনী প্রবীন এবং নবীন সবার মাঝেই চির অম্লান থাকবে বলেই আবক্ষ মূর্ত্তিগুলি স্থাপন করার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু নবীন প্রজন্মের কাছে কি সঠিক বার্তাটুকু পৌছতে পারছে ? কারন রক্ষনাবেক্ষন এবং নৈতিক দায়িত্ববোধের অভাবে খোয়াই শহরে এই মণীষীদের আবক্ষ মূর্ত্তিগুলি অবহেলিত হচ্ছে। আবক্ষমুর্ত্তিগুলি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব যেমন প্রশাসনের, তেমনি জনগনেরও। কিন্তু দায়িত্ব পালনে খোয়াইয়ের প্রশাসন কিংবা জনগন কেউই ততটা উচ্ছসিত নয় বলেই কি আবক্ষমূর্ত্তিগুলির এই হাল ? অথচ খোয়াই, আশারামবাড়ী, রামচন্দ্রঘাট এলাকার জনগনের জন্য প্রাণকেন্দ্র হল সুভাষপার্ক। কিন্তু এই সুভাষপার্ক এলাকার নামাকরন কে করলেন ? কিভাবে এই এলাকার নাম হল সুভাষপার্ক ? এমন সব তথ্য নবীণ প্রজন্মের কাছে আছে কি ?
এই এলাকার সৃষ্টি লগ্নেই তো নেতাজীর আবক্ষ মূর্ত্তি এখানে ছিলনা ? নাম ছিলনা সুভাষপার্ক। কে এর নামাকরন করলেন ? তথ্য বলছে ৬০ এর দশকে কোন এক দিনে, কয়েকজন আড্ডা স্থলে বসেই এই এলাকার নামাকরন সুভাষ পার্ক স্থির করেছিলেন। যদিও উনারা বর্তমানে প্রয়াত হয়েছেন। তারা হলেন স্থানীয় আরতি বিড়ি ফেক্টরীর মালিক প্রয়াত নৃপেন্দ্র দাস, ব্যবসায়ী মহেন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র ঘোষ, মালু চক্রবর্তী, জিতেন সরকার, হরেন্দ্র ঘোষ, মনোরঞ্জন ঘোষ, চারু দে প্রমুখ। এরাই ৬০ এর দশকে এই এলাকার নামাকরন করেন। তারপর ১৯৬৮ সাল থেকে স্থানীয় বিবেক সংঘ ক্লাবের যুবরা মিলে নেতাজীর জন্মদিন পালন শুরু করেন। শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা অবধি চলত নানান অনুষ্ঠান। সুভাষপার্ক কালিবাড়ীও এই বিবেক সংঘ ক্লাবের সদস্যরাই স্থাপন করেন। তবে যাইহোক, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরবর্তী সময় পূর্বতন নগর পঞ্চায়েত নেতাজীর জন্মদিন পালনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। তৈরী হয় নেতাজীর আবক্ষ মূর্ত্তি। স্থাপন করা হয় খোয়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র সুভাষপার্কে। সেদিনও বিরাট আকারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। নাচ-গান, আবৃত্তি, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা কি হয়নি সেদিন। কিন্তু এত ইতিহাস সম্বলিত খোয়াইয়ের বুকে এত ঘটা করে স্থাপিত নেতাজীর আবক্ষ মুর্ত্তিটি আজ অবহেলিত। দেখা যাচ্ছে এই আবক্ষ মূর্ত্তির পেছনেই আলো ঝিলমিল করছে, কিন্তু সুভাষপার্ক কোহিনুর মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আবক্ষ মূর্ত্তিটি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
বর্তমানে প্রশাসন সহ স্থানীয় সমাজসেবী সংগঠন এবং রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলিগুলি জনগনকে যার যার মতাদর্শ বোঝানোর চেষ্টা করেন। সমাজকে ভাল দিকে চালনা করার মত প্রকাশ করেন। কিন্তু যখন চোখের সামনেই আলোর রোশনাইয়ে ভরপুর কোহিনুর কমপ্লেক্সে চলে একের একের পর অনুষ্ঠান আর অন্যদিকে অন্ধকারে-অন্তরালে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন নেতাজী, ঘটনাটা কি অদ্ভূত বলে মনে হয়না ? সচেতনতা হাতে হাত ধরেই হবে, নাকি গলা হাঁকিয়ে সচেতনতার বার্তা উড়ালে। এবিষয়ে কারো কোন অনুশোচনা হয়না বলেই বর্তমান পুর পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষনও করা হয় না।
অথচ জনগনের অভিমত পুর পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে কর্মচারীগন সুভাষপার্ক বাজারে প্রতিদিন বাজার করতে আসেন। অথচ কোন এক অজ্ঞাত কারনেই এসব চোখে দেখেন না। জনমনে গুঞ্জন চলছে এদিন সন্ধ্যায় নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে চলছিল অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই নাকি ছোট ছোট শিশুরা তাদের অভিভাবকদের জিজ্ঞেস করছিল, ‘এই মুর্ত্তিটি কার ? অন্ধকারে দেখা যায় না।’ অভিভাবকরা টর্চ জ্বালিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইনি স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান নেতাজী। তিনি যখন জন্ম নিয়েছিলেন তখন বিদ্যুতের এত ঝলমল আলো ছিলনা। তাই তিনি বেশী আলো সহ্য করতে পারেন না।’ এভাবেই কিছু বলে সন্তানকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েন। এমন ঘটনাকি কি সত্যিই লজ্জাজনক নয় ? আবক্ষ মুর্ত্তিগুলির রক্ষনাবেক্ষনের পাশাপাশি এর আশপাশ স্থানগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও দাবি জানিয়েছেন জনসাধারন। তবে একমাত্র নেতাজীর মূর্ত্তি নয়, খোয়াই শহরে অবহেলিত প্রায় সব মনীষীদের আবক্ষ মূর্ত্তির একই দূর্দশা। তবে এই দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের একার নয়, আমাদেরও।
যদিও দায়িত্ববোধ, মানবিকতাবোধ কিংবা সচেতনতা, কোনটাই বর্তমানে খোয়াই শহরে বিরাজ করছেনা। এমনকি বিকেল থেকে রাত ৯টা অবধি কোহিনুর কমপ্লেক্সের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিংবা সামাজিক সংস্থার অনবরত অনুষ্ঠান লেগে থাকে। কি করে একটি ব্যস্ততম রাস্তার চৌমাথায় এভাবে দিনের পর দিন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয় প্রশাসন ? বিকেল থেকে সন্ধ্যা মানুষজনের ভীড়, যানবাহনের ভীড় সামলাতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় সেখানে ব্যস্ততম সড়কের পাশে সুভাষপার্ক বাজারের প্রাণকেন্দ্রে এভাবে দিনের পর দিন অনুষ্ঠানের পালা চলতে থাকায় স্থানীয় মানুষজনের নাভি:শ্বাস উঠলেও প্রশাসন এবং পুর কর্তাদের চোখে তা পড়েনা। সকলেই যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায়। প্রতিটি অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইক, সাউন্ড বক্সের উচ্চ গতি পথ চলতি মানুষকেই শুধু নয় আশেপাশের সমস্ত দোকানীদের নাজেহাল করে ফেলছে। একারনে অধিকাংশ দোকানীরাই প্রচন্ড ক্ষোভে ফুসছেন। একদিকে যানবাহনের আধিক্য, অন্যদিকে বিকেল থেকে একটানা অনেক রাত অবধি মাইকের শব্দ। মাত্রারিক্ত শব্দদূষনের কবলে সুভাষপার্ক বাজার ব্যবসায়ীরা কোন পথই খোঁজে পাচ্ছেন না। অথচ রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক বা সামাজিক সংস্থাগুলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য পুর পরিষদ কর্তৃক একখানা উন্মুক্ত মঞ্চ শহরের উপরই তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। ‘মোহর মুক্ত মঞ্চ’ ব্যবহার না করে সুভাষপার্ক কোহিনুর কমপ্লেক্সের সম্মুখ ব্যবহার করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার ফলে কোহিনুর কমপ্লেক্স কিংবা বাজার ব্যবসায়ীদের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। কিন্তু কেউই মুখ খুলে কিছু বলছেন না।
একদিকে শব্দদূষন অন্যদিকে মনীষীদের আবক্ষ মূর্ত্তিগুলির রক্ষনাবেক্ষনের অভাব। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দাবি শীঘ্রই নেতাজী এবং অন্যান্য মণীষীদের আবক্ষ মূর্ত্তিগুলিকে আলোর রোসনাইয়ে ভরে তোলা হউক। রাতের আঁধারে দেশের সম্মানকে একটু আলোকিত করার প্রয়াস করা হউক। সেই সাথে সুভাষপার্ক বাজারের মাঝে এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিংবা সামাজিক সংস্থার অনবরত অনুষ্ঠান অচিরেই বন্ধ করারও দাবি খোয়াইয়ের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের।