গোপাল সিং, খোয়াই, ২২ জুলাই ।। বুধবার সন্ধ্যা খোয়াইতে টানা দ্বিতীয় দফায় খোয়াই টাউন হলের দর্শক আসনে উপচে পড়া ভীড় দৃষ্টিনন্দনই শুধু হলনা, বরং নব্য নাট্যজগতকে একটা নতুন বার্তা দিয়ে রাখল। ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্র, খোয়াই বিভাগীয় কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী বিদ্যালয়ভিত্তিক শিশু কিশোর নাট্য উৎসবের সূচনা হল বুধবার। ২০শে জুলাই থেকে ২৪শে জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী উক্ত নাট্য উৎসবে খোয়াইয়ের সিঙ্গিছড়া ২নং, খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেনী বালিকা বিদ্যালয়, অশোকবন কলোনী, বারবিল, শৈব সুনীতি, গনকী কলোনী, লালছড়া, সুকান্ত স্মৃতি, তবলা বাড়ী, জাম্বুরা, অজগড়টিলা, শরৎচন্দ্র দ্বাদশ, খোয়াই চা-বাগান, অফিসটিলা, গনকী দ্বাদশ ও খোয়াই সরকারী ইংরেজী মাধ্যম এবং সরকারী দ্বাদশ শ্রেনী বিদ্যালয় সহ মোট ১৯টি স্কুল আমন্ত্রিতের তালিকায় থাকলেও অবশেষে ১৮টি স্কুলকে নিয়েই শুরু হয় শিশু কিশোর নাট্য উৎসব। শেষ মুহুর্তে জাম্বুরা দ্বাদশ এই নাট্য উৎসব থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বুধবার সন্ধ্যায় ১৮টি দলকে নিয়েই খোয়াই টাউন হলে আয়োজিত শিশু কিশোর নাট্য উৎসবের সূচনা করেন খোয়াই জিলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য্য। উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্রের বিভাগীয় সম্পাদক জীবন ঘোষ, সভাপতি উত্তম সিনহা, টিজিটিএ খোয়াই বিভাগীয় সম্পাদক দুলাল আচার্য্য প্রমুখ। উদ্বোধক তথা খোয়াই জিলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য্য উনার ভাষনে বলেন, ‘আমার খাবার কি হবে, পোষাক কি হবে, গান, সংস্কৃতি কি হবে তার সবটাই নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে একটা অংশ থেকে। যারা দেশটা পরিচালনা করছেন তারা অত্যন্ত সুকৌশলে এই কাজটা করার চেষ্টা করছেন। এর বিরুদ্ধে যদি এখনই প্রতিবাদ না করা গেলে একদিন আমরা আমাদের স্বাধীন সত্ত্বা হারিয়ে ফেলব। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি সমস্ত কিছু বিলীন হয়ে যাবে। শিশু কিশোরদের কাছে সংস্কৃতির আরও ব্যপক প্রসারের লক্ষ্যে সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্রের উদ্যোগের ভূয়শী প্রশংসা করে নাট্য উৎসবের সাফল্য কামনা করেন উদ্বোধক তথা খোয়াই জিলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য্য। অপরদিকে আপন সংস্কৃতিকে বাচানোর লড়াইয়ের মধ্যে আমরা অবস্থান করছি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্র, খোয়াই বিভাগীয় সম্পাদক জীবন ঘোষ। বললেন, সারা পৃথিবীতে এক গান, এক নাচ, এক পোষাকের প্রচলন। নিজের সংস্কৃতিকে বিচ্যুত করে সব কিছুকে এক করার প্রবনতা চালিয়ে যাচ্ছে শত্রুর মতো যে সংস্কৃতি তাকে মেনে নিলে তা হবে ক্রীতদাসের সংষ্কৃতি। এর থেকে বাচার জন্যই সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্রের এই প্রয়াস, এমনটাই বললেন ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্র, খোয়াই বিভাগীয় সম্পাদক জীবন ঘোষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরই নাট্য উৎসবের সূচনা লগ্নে উদ্বোধনী নাটক মঞ্চস্ত করে খোয়াই ডিরোজিও মিশন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। এদিন সন্ধ্যায় দুটি নাটক মঞ্চস্ত হয়। পরবর্তী নাটকটি মঞ্চস্ত করে খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। তবে শব্দ, আলো এবং মঞ্চ ব্যবহারে ত্রুটির ফলে ডিরোজিও মিশন স্কুলের নাটকটি দর্শকদের কাছে কোন বার্তাই পৌছাতে পারেনি। টাউন হলের দর্শকরা মাইক্রোফোনের গোলযোগে কোন কিছুই বোঝে উঠতে পারেননি। ভাল রিহার্সেল না হওয়ায় কলা-কুশলীরা সঠিকভাবে মঞ্চ ব্যবহার করে উঠতে পারেনি। সর্বোপরি শব্দ ও আলোর মধ্যে দূরত্ব ছিল বলেই অভিমত প্রকাশ করেন উপস্থিত দর্শকরা। এছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেও যথেষ্ট ত্রুটি ধরা পড়ে। তারপরও কলা-কুশলীদের অভিনব উদ্যোগ ও যৌথ প্রচেষ্টা দর্শকদের মন জয় করে নেয়। তবে আয়োজকদেরও বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। বিশেষ করে আয়োজকদের মনগড়া কয়েকটি স্কুলকে আমন্ত্রন জানানোর বিষয়টি দৃষ্টিকটু হয়ে পড়েছে। খোয়াই মহকুমায় ২৮৪ টি স্কুল থাকা সত্বেও কেন মাত্র ১৮টি স্কুল নাট্য উৎসবে অংশগ্রহন করল এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কেনই বা মহকুমার সবগুলি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে কোন আমন্ত্রনই যায়নি এরও কোন সদুত্তর মিলেনি। কেন প্রতিভার আত্মপ্রকাশের মঞ্চে শহরকেন্দ্রীক সুযোগ করা হল, কেনই বা গ্রামীন এলাকার স্কুলগুলিকে সুযোগ করে দেওয়া হলনা, এমনই প্রশ্ন তুলছেন সংস্কৃতি প্রেমী ব্যক্তিবর্গ। তবে বুধবার সন্ধ্যায় নাট্য উৎসবের উদ্বোধনী দিনেও চিরাচরিত প্রথা থেকে তিল পরিমান সরে আসতে পারেনি আয়োজকরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানমালা দীর্ঘায়তি করতে করতে মুল অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। অথচ স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা বিকাল চারটা থেকে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকেন টাউন হলের ভেতর। এত টানাপোরেনের পর এদিনও আয়োজকদের খামখেয়ালীতে ধৈর্য্য চ্যুতি হয় টাউন হলে উপস্থিত দর্শকমন্ডলীর। আয়োজকদের একঘেয়েমিতে প্রথম নাটক শেষ হবার সাথে সাথেই হল ত্যাগ করতে থাকেন অধিকাংশ অভিভাবক, দর্শকমন্ডলী। কারন দ্বিতীয় নাটকটি উপভোগ করতে হলে অনেক রাত হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় অনেকেই বাড়ী চলে যান। এছাড়া রয়েছে অটো বা অন্যান্য ছোট যানবাহনগুলির অভাব এবং বেশী রাতে টমটম চালকরা দ্বিগুন ভাড়া আদায় করে বলেই দূরবর্তী স্থান থেকে আসা দর্শকরা রাত ৮টার পর আর শহর থেকে দুরে কোথাও থাকতে চাননা। অন্তত এমন স্থানে যেখান থেকে ফিরতে যানবাহনের অভাব হবে বা দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে বাড়ী ফিরতে হবে। তবে বুধবার সন্ধ্যায় টাউন হলে মঞ্চস্থ দুটি নাটকেই দর্শকরা উপভোগ করতে পারতেন যদিনা আয়োজকরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে দীর্ঘায়িত করতেন। যেহেতু দর্শকরা দশকবাদে টেলিভিশনকে একপাশে রেখে মঞ্চের টানে দৌড়ে আসছেন তাই আয়োজকদেরও যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করে দর্শকদের মন জয়ে যোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। তবেই টাউন হল আবার আগেকার মত ভরে উঠবে স্বমহিমায়। শিশু কিশোরদের নিয়ে সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্রের নাট্য উৎসবের আয়োজনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন খোয়াইয়ের নাট্যমোদী দর্শকরা। কারন দর্শক কিন্তু যোগ্য মঞ্চ চাইছেন। যে মঞ্চ একঘেয়ামী না হয়। অনুষ্ঠান সূচী যেন মাথা ব্যাথার কারন না হয়ে উঠে সেদিকে আয়োজকদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। একসময় একঘেয়েমিপনা আর একরাশ অনুষ্ঠান সূচীর চাপেই সংস্কৃতি প্রেমী, নাট্যমোদী দর্শক মঞ্চ বিমুখ হতে থাকেন। খোয়াই জেলার প্রতিভাবান পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বা সহকারী যারা রয়েছেন ওনারা আজ-কালের এই পরিবর্তনের জন্য গৃহবন্দী। খোয়াইয়ের দর্শকমন্ডলী আবেদন জানাচ্ছেন যেন ওনারাও সঠিক সময়ে এগিয়ে এসে শুধুমাত্র মূল অনুষ্ঠানকে নন্দনীয়ভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করেন এবং দীর্ঘদিন বাদে ঘর ছেড়ে বের হওয়া দর্শকদের বিশাল স্রোতকে সামলে নিয়ে ১৯৩৭ইং থেকে খোয়াই শহরের সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চার ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে এগিয়ে আসেন।