প্রয়াত হলেন ত্রিপুরা বিধানসভার মুখ্যসচেতক তথা বিধায়ক সমীর দেব সরকার, গার্ড অব অনারের পর শেষকৃত্য সম্পন্ন নিজ বাসভনেই

-- প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেব সরকার
— প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেব সরকার

গোপাল সিং, খোয়াই, ২৮ আগষ্ট ।। চলে গেলেন খোয়াইয়ের আধুনিক রূপকার। জননেতা এবং ত্রিপুরা রাজ্য বিধানসভার মুখ্যসচেতক সমীর দেবসরকার, আজ তিনি নেই। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর রবিবার সকাল ৬ টা ২০ মিনিট নাগাদ আগরতলা জিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খোয়াইয়ের বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক সমীর দেব সরকার প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে উনার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। সমীর দেব সরকারের মৃত্যুর samir deb sarkar.jpg4খবর সকাল সকাল খোয়াইয়ে ছড়িয়ে পড়তেই খোয়াই জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।   সকাল থেকেই রাস্তার পাশে এবং সিপিআই(এম) খোয়াই জেলা কার্য্যালয়ের সামনে জনসমুদ্র তৈরী হতে থাকে। জনস্রোত দেখেই মনে হয় প্রয়াত সমীর দেবসরকারের জনপ্রিয়তা কতটুকু উচ্চ শিখরে ছিল, আছে এবং থাকবে। ৬টি বিধানসভf কেন্দ্রই সামলাতেন তিনি। প্রশাসনের কাজেও ছিলেন মধ্যমনি। যেকোন সরকারী পরিকল্পনাই উনি নিজের samir deb sarkar.jpg2হাতে তৈরী করতেন এমন নিখুঁতভাবে যে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারাও অবাক হয়ে যেতেন। খোয়াই শহরকে সাজাবার একটা রূপরেখা তৈরী করে রেখেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালের পর থেকেই কিভাবে খোয়াইয়ের দিকে ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্তের জনগনকে আকর্ষিত করা যায় সে দিকটায় পারদর্শীতার সাথে পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। যার জ্বলজ্যান্ত প্রমান বহন করে চলছে ত্রিপুরার পর্জটন মানচিত্রে খোয়াইয়ের বনবিথি পার্কের অন্তর্ভূক্তি। শুধুমাত্র বনবিথি নয়, জঙ্গল মহল, ঝিলিমিলি ইকো পার্ক, অত্যাধুনিক কালচারেল কমপ্লেক্স, কোহিনুর মার্কেট, হিমঘর সহ নানাভাবে খোয়াইকে নতুন রূপ দিতে সদা ব্যস্ত থাকতেন তিনি। খোয়াই থেকে তেলিয়ামুড়া পর্যন্ত অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র, পার্ক বা বিভিন্ন গলি-পথের রাস্তার নামাকরন সমীর দেবসরকারের দেওয়া। বলা চলে সকাল থেকে রাত দুটো পর্যন্ত শুধু কাজ আর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকা মানুষটা আজ আমাদের মধ্যে নেই।  রবিবার সকাল থেকে যে জনস্রোত খোয়াইতে দেখা গেল তা দেখে ভাবাই যায়না তিনি নেই। অথচ আকাশ-বাতাস যেন কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। তারপরও চোখে জল নিয়েই জনস্রোত ছুটে চলে প্রিয় জননেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবে বলে। তিনি যে যুব থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই ছিলেন একজন অভিভাবক। দলমত নির্বিশেষে উনার কাছে গিয়ে প্রতিকার পেয়েছেন। যতটুকু সম্ভব সমাধানও করেছেন তিনি। প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকারের সময়েই খোয়াই শহরে যারা সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত তারা যথাসম্ভব চাকুরী প্রদান করেছেন। উনার সময়কালে সংবাদ মাধ্যমের কর্মী এবং তার পরিবার চাকুরী পেয়েছে। কারন উনার নজর সব দিকেই ছিল। বিশেষ করে গরীব-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের প্রতি ছিল সর্বময় চিন্তা। আজ তাই গোটা খোয়াই জুরেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আগামীকাল বাজার ব্যবসায়ীরা ১২ ঘন্টার বাজার বন্ধ রাখার ঘোষনা করেছেন।  রবিবার বেলা বাড়ার সাথে সাথে সিপিআইএম খোয়াই বিভাগীয় অফিস এবং খোয়াই সুভাষপার্ক পার্টি অফিসের সামনে অসংখ্য লোকজন জড়ো হতে থাকেন। রবিবার সকালে আগরতলায় বিধানসভা ভবন, মেলার মাঠ স্থিত সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির কার্য্যালয় থেকে খোয়াইয়ের দিকে রওয়না হয় প্রয়াত সমীর দেবসরকারের মরদেহ। একে একে তেলিয়ামুড়া, কল্যানপুর, বাগান বাজার হয়ে খোয়াই সুভাষপার্ক লোকাল পার্টি অফিসে পৌছায় মরদেহ।  সেখান থেকে সিপিআই(এম) জেলা কার্য্যালয়ের সামনে আসলে সেখানে প্রতিক্ষমান জনতার ঢল নামে প্রয়াত বিধায়ককে অন্তিমবার দেখার সাধ নিয়ে। সেখানে দলীয় পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানান সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিজন ধর, মন্ত্রী খগেন্দ্র জমাতিয়া, বিধানসভার অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র নাথ, বিধায়ক মনীন্দ্র দাস, বিধায়ক পদ্মকুমার দেববর্মা, সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্যদ্বয় বিশ্বজিৎ দত্ত এবং রঞ্জিত দেববর্মা, খোয়াই বিভাগীয় কমিটির সদস্য সুখেন্দু বিকাশ দে, বিধায়ক অঞ্জন দাস, সিপিআই(এম) তেলিয়ামুড়া মহকুমা সম্পাদক সুধীর সরকার, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য প্রণব চক্রবর্তী, বিজয়লক্ষী সিনহা সহ স্থানীয় নেতৃত্বরা। পাশাপাশি কংগ্রেস, আমরা বাঙালি এবং তৃনমুল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও পুষ্পার্ঘ্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করল বামপন্থী শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠন এবং কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও। তারপর একে একে জনঢল উপচে পড়ে ফুল-মালা অর্পন করেন প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকারকে। তারপর বিকেলে উনার মরদেহ পৌছায় সিঙ্গিছড়া স্থিত নিজ বাড়ীতে। সেখানে পরিবারের লোকরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারপর গার্ড অব অনার দিয়ে প্রয়াত বিধায়কের নিজ বাসভবনেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গার্ড অব অনার দিল ৬ষ্ঠ ব্যাটেলিয়ান টিএসআর, খোয়াইয়ের এসপি, জেলা শাসক, মহকুমা শাসক এবং প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা। তেলিয়ামুড়া থেকে খোয়াই পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে এক ঝলক দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল অগণিত মানুষের ঢল। কান্নায় ভেঙে পড়ে অসংখ্য মানুষ।  প্রয়াত বিধানসভার মুখ্যসচেতক এবং বিধায়ক সমীর দেবসরকারের জন্ম ১২-১২-১৯৪৯। পিতা – প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র দেবসরকার, মাতা – প্রয়াত প্রতিভা দেবসরকার। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক পাশ করেন। রাজনৈতিক কেরিয়ারের সূচনা পার্টি সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালেই হয়। তারপর সিপিআই(এম) খোয়াই অঞ্চল সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭৮ সালে, সিঙ্গিছড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালে। সিপিআই(এম) খোয়াই অঞ্চল কমিটির সম্পাদক হন ১৯৮১ সালে, সিপিআই(এম) খোয়াই বিভাগীয় সদস্য হন ১৯৮১ সালেই। তারপর ১৯৮৪ সালে সম্পাদকমন্ডলীল সদস্য এবং খোয়াই বিভাগীয় কমিটির সম্পাদক হন ১৯৮৯ সালে। রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরুর ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে তিনি সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সদস্য হন। তারপর খোয়াই জেলা গঠনের পর ২০১৫ সালে তিনি জেলা কমিটির সম্পাদক হন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সারা ভারত কৃষক সভা এবং সিআইটিইউ’র সদস্য ছিলেন। ১৯৯২ সালটি বাদ দিলে তিনি ১৯৮৩, ১৯৯৩, ১৯৯৮, ২০০৩, ২০০৮ এবং ২০১৩ সালে পরপর ২৫-খোয়াই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। আমৃত্যু তিনি জনগনের জন্য ভাবনা-চিন্তা করে গেছেন। আরও কিছু কাজ উনি করে যেতে চেয়েছিলেন, যা অপূর্ণই রয়ে গেল।  উল্লেখ্য, গত ছয় মাস ধরে খোয়াইয়ের বিধায়ক সমীর দেব সরকার শ্বাস কষ্ট জনিত রোগে ভোগছিল। গত ছয়মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি সমীর দেব সরকার। গত কিছুদিন আগে চেন্নাই থেকে চিকিৎসা সেরে খোয়াই ফিরেন। গত সপ্তাহ কাল আগে ফের শ্বাস কষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হয় সমীর দেব সরকার। তখনি সমীর দেব সরকারকে নিয়ে যাওযা হয় জিবি হাসপাতালে। শেষ কয়েক দিন ধরে জিবি হাসপাতালের ভেন্টিলেশনে ছিলেন সমীর দেব সরকার। অবশেষে রবিবার সকাল ৬ টা ২০ মিনিট নাগাদ জিবি হাসপাতালের ভেন্টিলেশনেই সমীর দেব সরকারের মৃত্যু হয়েছে। সমীর দেব সরকারের মৃত্যুর খবর খোয়াইয়ে আসতেই খোয়াই জেলা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*