গোপাল সিং, খোয়াই, ০৯ সেপ্টেম্বর ।। খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকার সরকারী তথ্য অনুযায়ী মোট ২০,৭০০টি পরিবারের বাস। অন্তত খোয়াইতে এমন কোনও বাড়ী, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কোয়ার্টার নেই যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। অথচ সরকারী তথ্য অনুযায়ী খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে মাত্র ৮,৪৭৪টি পরিবারের। রীতিমতো চাঞ্চল্যকর এই তথ্য। আনুমানিক ১২ হাজার ২২৬টি পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও বিদ্যুৎ নিগমের রেকর্ডে নেই তাদের নাম। বিল জমা হয়না নিগমের অফিসে। আর এমনটা দিন-মাস-বছর নয় ১৯৮৭-ইংরেজীর পর থেকেই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আজ ১২ হাজার অতিক্রম করেছে। স্বাভাবতই ভাবতে অবাক লাগে গোটা রাজ্যে এভাবে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের পরিমান কতটা হতে পারে? আর এই অবৈধ বিদ্যুৎ ভোক্তাদের মাশুল গুনতে হচ্ছে আম জনতাকে। জোর করে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল। তারমধ্যে লো-ভোল্টেজে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের পকেট কেটে চৌচির হচ্ছে। ত্রিপুরাবাসীর থেকে প্রতি ইউনিট ৫০ বা ৭০ পয়সা করে নেওয়া যেত কিন্তু অবৈধ বিদ্যুৎ ভোক্তাদের কারনে তা আর বাস্তবের রূপ দেখছেনা।
খোয়াই জেলার বিদ্যুৎ নিগমের কোটি কোটি টাকার এই ঘোটালা সাধারন মানুষের কাছে এই প্রথম প্রকাশ্যে আসছে। সরকারী তথ্য এবং বাস্তব প্রেক্ষাপট চিৎকার করে বলছে বিদ্যুৎ নিগমের কোটি কোটি টাকার ঘোটালার কথা। জাগরন পত্রিকার খোয়াই প্রতিনিধির হাতে এসে পৌছায় খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকার এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি। আর এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি বিদ্যুৎ মন্ত্রী এবং বিদ্যুৎ নিগম কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তুলে ধরা হল। আমাদের হাতে থাকা তথ্যগুলি থেকে সহজেই জানা সম্ভব কিভাবে বিদ্যুৎ নিগমের গাফিলতির খেশারত আম জনতাকে দিতে হচ্ছে। খোয়াই জেলায় ৬টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। আজ শুধুমাত্র খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই বিধানসভা কেন্দ্রের কথাই তুলে ধরা হল।
খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকার সরকারী তথ্য অনুযায়ী মোট ২০,৭০০টি পরিবারের বাস। অপদিকে সরকারী তথ্য অনুযায়ীই খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকা এবং চেবরী এলাকা (চেবরী এলাকাটি খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই বিধানসভা কেন্দ্রের বাইরে) মিলিয়ে খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের ভোক্তার সংখ্যাটা কিন্তু ১৪,৭৭৪ (পরিবার)। তার মধ্যে চেবরী এলাকার প্রায় ২,৩০০ (পরিবার) ভোক্তা বাদ দিলে খোয়াইয়ের বিদ্যুৎ ভোক্তার সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১২,৪৭৪ (পরিবার)। কিন্তু এই সংখ্যার মধ্যে শুধু পরিবারই নয়, রয়েছে সুভাষপার্ক-মহারাজগঞ্জ-সোনাতলা-মহাদেবটিলা-জব্বরটিলা-আমতলি-সিঙ্গিছড়া-সিঙ্গিছড়া প্যাক্সের বাজার-দূর্গানগর-লালছড়া ও পহরমুড়া বাজার সহ রাস্তার পাশের সমস্ত দোকান-পাট, থানা-কোয়ার্টার-হাসপাতাল সহ সমস্ত সরকারী অফিস ইত্যাদি মিলিয়ে আনুমানিক যদি সংখ্যাটা ৪ হাজারও ধরা হয় তবে শেষ পর্যন্ত খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় বৈধ ভোক্তা বা পরিবারের সংখ্যটা দাঁড়ায় আনুমানিক ৮,৪৭৪-এ (পরিবার)। তার থেকেও মাত্র ৫২% বিল আদায় হয় জনগনের কাছ থেকে। অথচ সরকারী তথ্য অনুযায়ী খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় বৈধ রেশন কার্ডভূক্ত পরিবার রয়েছে ২০,৭০০টি (পরিবার)। তাহলে সরকারী তথ্য এবং বাস্তবের মধ্যে ব্যবধানটা আনুমানিক দাঁড়ায় ১২,২২৬-এ (পরিবার)। মানে বিদ্যুৎ নিগমেরই তথ্য অনুযায়ী খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় আনুমানিক ১২,২২৬টি পরিবারে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। তবে নিগমেরই এক কর্তা জানালেন-‘এভাবে তথ্য দেখালে হবে না। এমন অনেক পরিবার রয়েছে যেখানে একই পরিবারে রেশন কার্ড ৩-৪টি কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ ১টি। আবার কোন কোন পরিবারে রেশন কার্ড ১টি কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ ৪টি। কারন বর্তমান সময়ে বিদ্যুতের ইউনিট চার্জ বেশী হওয়ায় অনেক পরিবারই একই নামে ৩-৪ খানা কানেকশন নিয়ে নিয়েছেন। তাহলে শেষ অবধি হিসাবটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? যেখানে খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগহীন একটি বাড়ীও নেই সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগবিহীন ১২,২২৬টি পরিবার কোথা থেকে এবং কিভাবে এল? এই পরিবারগুলি বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে কিন্তু বিল দিচ্ছেনা, এমনটা কি হতে পারে?
খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় (রেশন কার্ডভুক্ত পরিবার)
(সরকারী তথ্য অনুযায়ী) মোট পরিবার = ২০,৭০০টি
(সরকারী তথ্য অনুযায়ী) খোয়াই বিদ্যুৎ দপ্তরের অধীনে,
খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ও চেবরী এলাকা সহ মোট বিদ্যুৎ ভোক্তা (পরিবার) = ১৪,৪৭৪টি
চেবরী(খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই বিধানসভার বাইরে) মোট বিদ্যুৎ ভোক্তা (পরিবার) = ২,৩০০টি
চেবরী এলাকা বাদ দিলে সরকারী তথ্য অনুযায়ী,
খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় মোট বিদ্যুৎ ভোক্তা (পরিবার) = ১২,৪৭৪টি
তার মধ্যে খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকার সরকারী সমস্ত অফিস-থানা-কোয়ার্টার-হাসপাতাল এবং বাজার-দোকানপাট মিলিয়ে (আনুমানিক) যদি বিদ্যুৎ ভোক্তা ধরা হয় = ৪,০০০
তবে সরকারী তথ্য অনুযায়ী,
খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় মোট বিদ্যুৎ ভোক্তা (পরিবার) দাঁড়াল = ৮,৪৭৪টি
তাহলে খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায় যদি সবার বাড়ীতেই বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে থাকে তাহলে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে উঠে আসছে – (২০,৭০০ – ৮,৪৭৪ = ১২,২২৬টি পরিবার)
সরকারী তথ্য অনুযায়ী খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকায়
মোট = ১২,২২৬টি পরিবারে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।
(আনুমানিক ১২ হাজার ২২৬টি পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও, বিদ্যুৎ নিগমের রেকর্ডে নেই তাদের নাম)
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোন প্রকার নিগমের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন এলাকায়, গ্রামে-গঞ্জে বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে নগদ টাকার বিনিময়ে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গরীব-শ্রমিক জনগন মনে করেন সারাদিন কাজ বাদ দিয়ে নিগমের অফিসে গিয়ে মাসের পর মাস ঘুরে বাড়ীতে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যায় না। আজ ইঞ্জিনিয়ার বাবু আসেন না তো কাল সার্ভিস বৈদ্যুতিক তার নেই, মিটার নেই এবং নানান ঝামেলা। সুতরাং বাড়ীতে বসেই যদি কিস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যায় তবে কেন এই সুযোগ গ্রহন করব না। এমনটা ভেবেই গরীব মানুষ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের স্বীকার হয়ে যান। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায় কিন্তু বিল নেওয়ার জন্য কেউই আসেনা। কেউ কেউ খুশি হন বিল দিতে হয়না বলে। আবার কেউ কেউ সততার সাথে খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের বিল কাউন্টারে বিল জমা করাতেও আসেন। কিন্তু সেখানেও কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মী জড়িত থাকায় গ্রামের অবোঝ মানুষদের সাত-পাঁচ বুঝিয়ে টাকা রেখে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন।
এই ঘটনাগুলি আজকের নয় আনুমানিক ১৯৮৭ ইং থেকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ঐ সময় থেকে যদি রেভিনিউ আদায়কারী বা অফিস কর্মীদের আজকের সময় পর্যন্ত দেখা যায় এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হয় তবে বোঝা যাবে বিভিন্নভাবে নিগমকে ক্ষতির মুখে কিভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। শুধু গ্রাহকের ক্ষেত্রে নয় ঠিকেদারদের ক্ষেত্রেও তথৈবচ অবস্থা। বিদ্যুৎ নিগমের বর্তমান দু-একজন ঠিকেদার আজ নিগমকে লুটে বিশাল বিত্তশালী। তবে যাইহোক আংশিক সচেতন নাগরিক কিন্তু বৈধ-অবৈধ কানেকশন না বোঝলেও উনারা বিদ্যুৎ বিল দিতে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে টাকা নেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। কারন কোন প্রকার রেকর্ড নেই। সরকারী রেকর্ডের বাইরেও হাজার হাজার ভোক্তার বিল আজ বকেয়া।
এদিন সিঙ্গিছড়া গ্রামের এক গৃহবধূ খোয়াই বিদ্যুৎ নিগম অফিসে বিল দিতে আসেন। তিনি জানালেন উনার বাড়ীতে গিয়ে দু’জন বিদ্যুৎ কর্মী জিজ্ঞেস করেন বাড়ীতে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগবে কিনা। সব টাকা দিতে পারবেন না বললেও দু’বারে কিস্তিতে টাকা দিলেও চলবে বলে কানেকশন নিতে আগ্রহ দেখান। টাকা দেওয়ার সাথে সাথেই মিটার সহ কানেকশন দিয়ে দেওয়া হয়। বৈদ্যুতিক মিটারের নং-২৯২৪৭৪২। কানেকশন দেবার পর থেকে ঐ মহিলা বহুবার নিগমের অফিসে বিল জমা দিতে এসেও টেবিলে টেবিলে ঘুরে আর বিল জমা করাতে পারেননি। কারা বিল জমা রাখেন নি তাদের নাম-ধাম জানানো সত্বেও দপ্তর নীরব। নিজের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছেড়ে বিল দিতে এলেও বিল রাখার কেউ নেই বলে আক্ষেপ করলেন ঐ মহিলা। জানা যায় এসমস্ত কারনেই বাকিরাও (অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহারকারীরা) আর বিল দিতে আসেন না। অথচ এসমস্ত তথ্য সংক্রান্ত সংবাদ এর আগেও জাগরন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সব জেনেশুনেও দপ্তর কেন নীরব ভূমিকায় তার কোন সদুত্তর মিলেনি। ভাবতে অবাক লাগে যদি দপ্তর উদ্যোগ নিয়ে ঐ সমস্ত অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের তালিকাভূক্ত করত তবে হাজার হাজার টাকা নিগমের কোষাগারে জমা হতো। খোয়াই বিদ্যুৎ নিগমের অন্তর্গত খোয়াই ব্লক ও পৌর সভা এলাকাতেই যদি এই হাল হয় তবে বাকি আশারামবাড়ী, রামচন্দ্রঘাট, কল্যানপুর, তেলিয়ামুড়া, কৃষ্ণপুর এর বিদ্যুৎ নিগমের কি হাল ? সরকারী তথ্যের সাথে বাস্তবিকতার যেন দুর-দূরান্ত পর্যন্ত কোন লেনদেন নেই তাতেই অনুমান করা যায় শতকরা ৭৫ টাকা উড়ে যাচ্ছে আর জনগনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি বিদ্যুৎ মাশুল। যদি সঠিক তদন্ত হতো তবে আর রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে ঋণ নিয়ে দেনা পরিশোধ করতে হতো না। তাই অতিসত্বর এবিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন জনসাধারন। বিদ্যুৎ দপ্তরের তার ও মিটার অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগককারীদের কাছে কিভাবে পৌছোয়? নাম-ধাম দিয়ে জানালেও খোয়াই বিদ্যুৎ নিগম উনাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা বলেই অভিযোগ জনগনের। তাছাড়া বর্তমান সময়ে সমস্ত নথি কম্পিউটারাইজড হবার ফলে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। নিগমের যদি এধরনের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে অতি সত্বর তদন্ত করে সত্য উদঘাটন করার দাবি জানিয়েছেন জনসাধারন।