গোপাল সিং, খোয়াই, ০৬ অক্টোবর ।। বছর ঘুরে উমা দেবী আবার এসেছেন তার বাপের বাড়ি। ঢাকের কাঠি ঢেম কুড় কুড়, ঘণ্টা-কাসার টিং টিং, মঙ্গল শাঁখ ও নববধূর উলু ধ্বনির সাথে মায়ের আগমন উপলক্ষে চারদিকে কেবল আনন্দ আয়োজন। দুর্গোত্সব মানেই বাঙালির প্রাণের উত্সব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলে এই আনন্দ আয়োজনে সামিল হয় বলে দুর্গাপূজাকে বলা হয় সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গোত্সব। ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ভুলে মণ্ডপে মণ্ডপে এখন শোনা যায় মা আনন্দময়ীর আগমনী স্তুতি। দুর্গাপূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ, পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও সুন্দরের যুদ্ধ। দুর্গতি থেকে রক্ষা, বিভেদ, বিবাদ, অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্রস্বার্থবোধ ও সংকীর্ণতা প্রভৃতির ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মহাশক্তির বর লাভের নিমিত্তে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একদিন পরই মেতে উঠবেন দেবী বন্দনায়। মাতৃ আরাধনায় পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে চলছে চুড়ান্ত প্রস্ততি।
বর্তমান সময়ে বাঙ্গালীর শ্রেষ্ট উৎসব শারদোৎসব এখন সার্ব্বজনীন শরদোৎসবের রুপ নিয়েছে। শারদোৎসবকে সাজিয়ে তুলতে এবং নিজেকেও মানানসই করে নিতে দোকানে-শপিং মলে, সর্বত্রই মানুষের ঢল উপচে পড়েছে। নতুন জামাকাপর কেনা-কাটার পালা পূজার একদিন আগেও উর্দ্ধগামী। এবছর তেমন কোন চমক না থাকলেও খোয়াইয়ের প্রায় সবক’টি ক্লাব এবং পূজো উদ্যোক্তারাই নতুন কিছু উপহার দিতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি প্রায় সেড়ে ফেলেছেন। চলছে শেষ তুলির টান। খোয়াই মহকুমার দুটি থানা এলাকাতে মোট ১২০টির উপর পূজো হচ্ছে। প্রায় অধিকাংশ পূজো উদ্যোক্তাদেরই এবছর লক্ষ্য বাজেটে নয় থিমে। থিম পূজোর দিকে ঝোঁক এবার খোয়াই জেলার সর্বত্রই।
খোয়াই শহর এবং শহরতলীতে যে সমস্ত বনেদী ক্লাব বা অন্যান্য পূজো উদ্যোক্তারা রয়েছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানান থিম নিয়ে মন্ডপ সজ্জায় হাত লাগিয়েছেন। খোয়াই শহরাঞ্চলের পূজোগুলির মধ্যে খোয়াই অফিসটিলার স্কাইলার্ক ক্লাব এবছর তিন লক্ষ টাকা বাজেটে পূজোর আয়োজন করছে। গড়ে তোলা হচ্ছে সুদৃশ্য প্যান্ডেল। একই ভাবে জিএবি ক্লাব, বিপিসি ক্লাব, এভারগ্রীন ক্লাব, বাঘাযতীন ক্লাব এবং অগ্রদূত ক্লাব অন্যান্য বছরের থেকে কম বাজেটে পূজার আয়োজন করেছে। তবে গত বছরের মত এবারও পদ্মবিল হামবাই ক্লাব ভাল পুজার উদ্যোগ নিয়েছে। রামচন্দ্রঘাট স্থিত টিএসআর ৬ষ্ট বাহিনীর সদর কার্যালয়েও প্রতি বছরের মত এবারও বড় পরিসরে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। হামবাই ক্লাব যেখানে সুদৃশ্য কাল্পনিক মন্দির নির্মান করে চমক দিচ্ছে সেখানে টিএসআর ৬ষ্ট বাহিনীর সদর কার্যালয়েও থাইল্যান্ডের একটি প্যালেসের আদলে সুদৃশ্য প্যান্ডেল তৈরী করেছে বাহিনীর জওয়ানরাই। প্রতিবছরই খোয়াই শহর ফাঁকা করে জনঢল নামে পদ্মবিল এবং রামচন্দ্রঘাটের মন্ডপগুলোতে। তবে এবছর এর অন্যথাও হতে পারে। কারন খোয়াই গনকী এলাকার স্থানীয় অগ্রদূত ক্লাব এবছর ছোটদের মন জয় করতে আকর্ষনীয় মন্ডপ সজ্জা করেছে।
১। খোয়াই শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতি বছরই স্বল্প বাজেটে পূজোর আয়োজন করে আসছে জিএবি ক্লাব। এবছরও দৃষ্টিনন্দন পূজা মন্ডপ তৈরী করা হচ্ছে। চলছে শেষ তুলির টান। এবছর রঙ-ধনু’র আদলে তৈরী হয়েছে নজরকাড়া মন্ডপ। শহরের উপর চাকচিক্যে ভরা এই পূজো মন্ডপ দর্শনার্থীদের মন নিশ্চই ভরে তুলবে। তাছাড়া প্রতি বছরই সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
২। শিশুদের কথা মাথায় রেখে এবছর অগ্রদূত ক্লাবের পুজার মন্ডপ হচ্ছে ছোটা ভিম কার্টুন সিরিয়ালে দৃশ্য গ্রামকে অনুকরন করে। ছোটা ভিম-এর ঢোলকপুর গ্রামের পরিবেশকে তোলে ধরার চেষ্টা করেছে জনপ্রিয় মন্ডপ শিল্পী অলক চৌধুরী। বাশঁ, কাঠ, কাপর, চট দিয়েই তৈরী হচ্ছে মন্ডপ। তিন লক্ষ টাকার বাজেটে অগ্রদূত ক্লাব এবারকার পূজার আয়োজন করেছে। পূজার দিন গুলিতে মন্ডপে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
৩। লাল ছড়ার সুপরিচিত বাঘাযতীন ক্লাব বরাবরই বড় বাজেটের পূজার আয়োজন করে। এবারও প্রায় চার লক্ষ টাকার বাজেটে পুজার আয়োজন করেছে। পূজা মন্ডপে জাতি-উপজাতির সম্প্রীতিকে প্রাধান্য দিয়ে পাহাড় সমতলকে তোলে ধরার চেষ্টা করছে বাঘাযতীন ক্লাব। কাঠ কাপর বাশঁ দিয়ে পাহাড় সমতলের দৃশ্য তোলে ধরার চেষ্টা করছে মন্ডপ শিল্পী কুন্তল নাথশর্মা। প্রতি বছরের মত পূজার দিন গুলিতে মন্ডপ প্রাঙ্গনে চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলবে সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচী। বস্ত্র বিতরনও করা হবে বলে জানায় বাঘাযতীন ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
৪। খোয়াই সিঙ্গিছড়া এলাকার ‘দ্বীপ জেলে যাই’ ক্লাবটি চার লক্ষ টাকা ব্যায়ে এবছর পূজার আয়োজন করেছে। টানা তৃতীয় বছর এই ক্লাবটি পূজোর আয়োজন করতে চলছে। কোলকাতার একটি পুজা মন্ডপের অনুকরনে তৈরী হচ্ছে মন্ডপ। কাঠ, কাপড় দিয়ে তৈরী হচ্ছে দর্শনীয় মন্ডপ। প্রচুর লোকসমাগম হয় ক্লাবের এই পূজা মন্ডপে। এবছরও অন্যথা হবেনা বলেই মনে করছে পূজো উদ্যোক্তারা।
৫। এছাড়া স্থানীয় কিশোর সংঘ, ভারতকল্যান সংঘ, নিউ পোলষ্টার সোসাইটি, ফাইনাইট ক্লাব, এভারগ্রীণ ক্লাব, যথারীতি স্বল্প বাজেটে পূজার আয়োজন করেছে। এছাড়া রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কিছু পূজা যেমন মহারাজগঞ্জ বাজার, হরিমন্দির, সহ হাতেগুনা কয়েকটি বনেদী বাড়ীর পূজো।
৬। খোয়াই শহরতলী থেকে দূরে পদ্মবিল এলাকার জনপ্রিয় পূজার আয়োজন করে চলছে স্থানীয় হামবাই ক্লাবটি। ছয় লক্ষ টাকা বাজেটে পূজার আয়োজন করছে পদ্মবিল হামবাই ক্লাব। এবছর হামবাই ক্লাব কোলকাতার একটি পুজা মন্ডপকে অনুকরন করে মন্ডপ তৈরী করছে। ৭০ফুট লম্বা এবং ৬০ফুট উচ্চতার মন্ডপ তৈরী করছে শিল্পী জমাদার দের্ব্বমা এবং দেবব্রত দের্ববমা। গত বছরেও পদ্মবিলের হামবাই ক্লাবের পুজা মন্ডপে প্রচন্ড ভিড় ছিল দর্শনার্থীদের। রাত ভড় দর্শনার্থীদের ভিড় নিয়ন্ত্রন করতে হিমসীম খেতে হয়েছে ক্লাবের কর্মকর্তা থেকে আরক্ষা বাহিনীকে। ধারনা করা হচ্ছে এবারও একই অবস্থা হবে।
তবে যাইহোক এবছর যে খোয়াইতে বিগ বাজেটের পূজা না থাকলেও দর্শনার্থীদের মন জয় করার রশদ রয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। পূজো উদ্যোক্তারা থিম পূজায় মনোনিবেশ করেছেন এবং সেই সাথে সামাজিক কর্মসূচীতো রয়েছেই। তবে সর্বোপরি পূজার এই ক’টা দিন দেবীর চরণে ভক্তদের কাতর মিনতি থাকবে এবারের দুর্গোত্সব যেন সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত ভালোবাসার স্পন্দনে মথিত, গৌরাবান্বিত করে তোলেন সবাইকে।