NRHM প্রকল্পের বিভিন্ন করুন দশা

gbগোপাল সিং, খোয়াই (আগরতলা থেকে ফিরে), ০৬ ডিসেম্বর ৷৷ ত্রিপুরা রাজ্যের একমাত্র বড় এবং নানাহ চিকিৎসার কেন্দ্র হল আগরতলা জিবি হাসপাতাল। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমার বিশেষ করে গরীব-শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষরা ছুটে আসেন জিবি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা গ্রহন করতে। অন্যদিকে সমাজ পরিচালকগন অধিকাংশরাই আই-এল-এস বা বেশীরভাগ অবৈজ্ঞানিক নার্সিং হোমগুলিতে ছুটেন। নিজের বা পরিবারের জীবন রক্ষার তাগিদে গবাদী পশু, জমি বন্ধক বা মহাজন থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে আগরতলা শহরের বেশীরভাগ নার্সিং হোমে ছুটে যান সাধারন মানুষজন। সুস্থ্য হবার আশায়। ধারাবাহিকভাবে জাগরন পত্রিকায় তিনদিন যাবত এনিয়ে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। কিভাবে গরীব মানুষ চিকিৎসার নামে নরক যন্ত্রনার স্বীকার হচ্ছেন তাও বাস্তব অভিজ্ঞতার ছবি গত কিছু দিনের আপডেটে তুলে ধরা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যেই আজকের বিষয়ে উঠে এল জিবি হাসপাতালের জন্ম-মৃত্যু বা এনআরএইচএম প্রকল্পের বিভিন্ন করুন দশা।
কিভাবে একটি গরীব পরিবারকে শিশুর জন্ম পঞ্জিকা আনতে প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে, সাথে মিলছে হয়রানী। প্রথমেই আসি জননী সুরক্ষার বিষয়ে। একজন গরীব রোগীকে যদি খোয়াই থেকে আগরতলা পাঠানো হয় তবে জননী সুরক্ষা থেকে গাড়ী ভাড়া বাবদ ৮০০ টাকা দেওয়া হয়। আবার আগরতলা থেকে আসতে দেওয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। তাও আবার শতকরা হিসাবে। দেখা যায় ৯০ শতাংশ জনগনই টাকা পায়না। কারন জননী সুরক্ষা যার উপর দায়িত্বভার ন্যাস্ত উনি প্রতিদিন দুপুর ১২টায় আসেন আবার ২টায় চলে যান। আবার বুধবার ছাড়া টাকা দেওয়া হয়না। অর্থ্যাৎ সেলুকাসের রাজ্য ! খোয়াই থেকে আগরতলা যদি ৮০০ টাকা ভাড়া দেওয়া হয় তবে আগরতলা থেকে খোয়াই আসতে ৫০০ টাকা কেন ? জনমনের এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। কিন্তু সপ্তাহে যদি একটি মাত্র দিন টাকা দেওয়া হয় তবে বাকি দিনগুলি টাকা পাবে না গরীব রোগীরা। তারপরও যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে পাওয়াও যায় তবে কাগজপত্র জমা দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। উনি পরে তারিখ বলে দেবেন। জনগনের প্রশ্ন, কৈলাসহর, ধর্মনগর, কমলপুর, খোয়াই, বিলোনীয়া, রইস্যাবাড়ী, গন্ডছড়া, অমরপুর সহ যারা দূর-দুরান্ত থেকে আসেন তাদের এই ৫০০ টাকা নিতে কতটাকা গাড়ী ভাড়া খরচ করতে হবে? বাধ্য হয়েই শতকরা হিসাবে ৯০ শতাংশ জননী সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত।
সেইসাথে তথৈবচ অবস্থা জন্ম-মৃত্যুর প্রমানপত্র নেওয়ার ক্ষেত্রেও। প্রথমে আপনাকে বৈধ ফর্ম ৫ টাকা দিয়ে কিনে (যদি অফিস না চেনেন তবে দালাল দিয়ে ১০ টাকা ফর্ম এবং লেখা বাবদ ২০ টাকা ও জুতোর শুকতলি বাবদ ২০ টাকা মিলিয়ে ৫০ টাকা খরচ করে) ফর্ম জমা দিতে হবে। তারপর আপনাকে জানানো হবে ৩০ বা তার বেশী সময় পর আসার জন্য। আবার সেই একই প্রশ্ন উঠে আসছে। কৈলাসহর, ধর্মনগর, কমলপুর, খোয়াই, বিলোনীয়া, রইস্যাবাড়ী, গন্ডছড়া, অমরপুর সহ যারা দূর-দুরান্ত থেকে আসেন তাদের কত টাকা গাড়ী ভাড়া আবার খরচ হচ্ছে? তাও যখন প্রয়োজনীয় কাগজ নিতে আসলেন, যিনি টেবিলে বসেন, গরীব মানুষের সেবার জন্য যাকে বসানো হয়েছে উনাকে হাত জোড় করে গ্রামের ময়লা কাপড়, উসকু-খুসকো দাড়ি নিয়ে শুকনো মুখে বললেন, স্যার আমার শিশুর জন্মের সার্টিফিকেট হয়েছে কিনা ! উনার মুখের সাচি পানটা একটু চিবিয়ে নরম করে ওয়ালের কাছে পিক ফেলে কোন কিছু না দেখেই বললেন, ওহ ! কবে কইছিলাম আওনের কথা ? স্যার, এক মা পর। এক মাস হইছে? সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব ব্যষ্ত। কত কাজ। জন্মের সার্টিফিকেটে সই করার সময় কই। একমাস কইলেই কি এক মাসে হয় ! আইয়েন আরেকবার। স্যার, রইস্যা বাড়ী থেকে কত কষ্টে আইছি। ৪টা হাঁস বিক্রি কইরা আইছি। আবার আইতে কত কষ্ট হইব। এসব আমারারে শুনাইয়া কাজ হইতনা। সামনে থাইক্যা সরেন। হয়তো গরীব মানুষের শরীরে উদভট গন্ধ থাকতেই পারে। খেটে-খাওয়া মানুষ বলে কথা। মাটির গন্ধ আজকাল উদভট বলেই মনে করেন অনেকেই।
তবে যাইহোক সেখান থেকে মন খারাপ করে বের হতেই দালাল এসে হাজির হয়। কাকা কি কইছে? আবার আগামী মাসে আইতে কইছে? ২০০ টাকা আছেনি? লইয়া দিমু। বাবু ২০০ টাকা দিলে দুপুরে ভাত খাইয়া যাইতে পারতাম না। শেষে সরকারী পরিষেবার এই হাল সহ্য করেই ব্যাথিত হৃদয়ে তিনি চলে গেলেন।
এভাবেই সমগ্র সরকারী কাজ চলছে জিবি হাসপাতালে। যে জায়গায় ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার জনগনের বাড়ীর কাছে প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পৌছে দিতে প্রয়াস চালাচ্ছে, সে জায়গায় একটি শিশুর জন্মের প্রমানপত্র বা সার্টিফিকেট আনতেই মাসের পর মাস রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আগরতলা জিবি হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। হয়রানীর স্বীকার হতে হচ্ছে। পকেট কাটছে। নি:স্ব হচ্ছে গরীব মানুষ। অথচ গোটা বিষয়টিকেই সহজ করা যায়। যেমন জিবি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া শিশুর অভিভাবকের হাতে জিবি হাসপাতালের জন্মের প্রমানপত্র তুলে দেওয়া হয় এবং যার যার মহকুমায় হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতাল থেকে নিজ এলাকার থেকে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। তবেই রাজ্যের গরীব-শ্রমিক-কৃষক পরিবারের সাধারন মানুষ একটু বেঁচে যেতেন। এভাবে ধার-দেনা করে বারবার হাসপাতালে যেতে হতোনা। জননী সুরক্ষায় বিভিন্ন সুযোগ যদি সঙ্গে দেওয়া হয় তবে অনেক কিছু লাঘব হবে। অন্যান্য মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে জননী সুরক্ষার সুযোগ মানুষ সাথে সাথেই পায়। গ্রামের মানুষকে সব কিছুতেই দেখা যায় আগরতলায় গেলে নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। তাই যদি প্রশাসনিক কাজের একটু সরলীকরন করা যায় এবং সেবক-সেবিকা যদি একটু সচেতন হন তবে রাজ্যের বৃহৎ অংশের জনগন প্রকৃতপক্ষেই উপকৃত হবে, এমনটাই দাবি জনগনের।

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*