বাংলাদেশ, ১৫ ডিসেম্বর ।। আজ ১৫ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের অবাঙ্গালী অধ্যুষিত খ্যাত দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত দিবস। বাংলাদেশে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দিনে মুক্ত হয় পার্বতীপুর।
৭১- এর ২৩ মার্চ পার্বতীপুর শহরে বসবাসরত অবাঙালীদের বৈষম্য মূলক আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে গ্রামগঞ্জের সাধারন মানুষ শহর ঘেরাও করে এবং সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নি সংযোগ করে।
এ সময় বাংলাদেশে অবাঙালীরা নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর ব্যাপক গুলি বর্ষন করলে অনেক বাঙালী প্রাণ হারায়। সে সময়ে অবাঙালীদের গুলিতে প্রাণ হারানো কালাইঘাটির রইচ উদ্দিন, আটরাই গ্রামের দুখু মিয়া, বেলাইচন্ডির মোজ্জামেল হকের নাম উল্লেখ যোগ্য।
২৪ ও ২৬ মার্চ সেই সময়ের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ইমাম হোসেন মোল্লাসহ ১১ জন, এস আহম্মেদের ৪ জন কর্মচারী, অমর টকিজ সিনেমা হলের মুসলিম ম্যানেজারের সমস্ত পরিবারের সদস্য, অহিত কোম্পানির ২ জন কর্মচারী, কাশিয়া তেলীর পরিবারের ৪ জন, পার্বতীপুর থানার এ এস আই গোলাম পরিবারের সকল সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের পুত্র ডাক্তার শামসাদকে কয়লার ইঞ্জিনের বয়লারে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
এ গণহত্যার পর বাঙালীরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। এর পর প্রায় আড়াই’শ তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসে তাবু ফেলে বাংলাদেশের খোলাহাটির নুরুল হুদার আটরাই গ্রামে। তারা স্থানীয় তরুনদের নিয়ে সংগ্রামী দল গঠন করতে থাকে। তাদের হাতে ধরা পড়ে একজন অবাঙালী এস,পি এবং দু’জন ট্রাক চালক।
২৮ মার্চ পাক বাহিনীর একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধিনে কয়েক জন বাঙালী সৈন্য হুগলীপাড়ার সিও’অফিস চত্তরে (বর্তমানে উপজেলা পরিষদ চত্বর) পাহারা দিচ্ছিল। দ্বিতলী ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙালীদের তৎপরতা লক্ষ্য করে ওয়ারর্লেসে খবর দেয়ার চেষ্টা করলে এক বাঙালী সৈন্যের সাথে বাক-বিতান্ডের এক পর্যয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা জেনে ফেলায় হুগলীপাড়া গ্রামের ছাত্র আঃ লতিফকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এবং জ্বলন্ত কয়লার ইঞ্জিনের বয়লারে পোড়ানো হয়।
১ এপ্রিল সংগ্রামী যুবকদল বৃত্তিপাড়ার নিকট র্মটার বসিয়ে সন্ধ্যার পর এক যোগে ৪র্থ মুখে আক্রমন চালায় পার্বতীপুর শহরে। শেষ রাতে হঠাৎ কামান গর্জে ওঠে। ভোরে তুমূল গোলাগুলি শুরু হয়। প্রচন্ড শব্দে সেল নিক্ষিপ্ত হয় শহরের সোয়েব বিল্ডিং এর উপর। ভেঙ্গে যায় ৪ তালা ভবনের চিলে কোঠা।
২ এপ্রিল পাকসেনা ও অবাঙালীরা হিংস্রতায় উন্মুত্ত হয়ে পার্বতীপুরের ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে গ্রাম-গঞ্জে অগ্নি সংযোগ, হত্যা, ধর্ষন ও নির্যাতন চালায় বাঙালীদের উপর। এ দিনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় অনেক বাঙালীকে। এর মধ্যে চন্ডিপুর ইউনিয়নের জাহানাবাদ কালেখাপাড়া গ্রামের রহমতুল্লাহ’র পুত্র সৈয়দকে নির্মম ভাবে আগুনে পুড়ে হত্যা করা হয়।
একই দিনে পার্শ্ববতী পুকুরপাড়া গ্রামের লালমিয়ার স্ত্রী অহেদা বেগম ও যুবতী মেয়ে এবং তাজর উদ্দিনকে একসংগে গুলি করে হত্যা করে।
বাজারপাড়া গ্রামের মোস্তো হাজী ও মামুন পাড়ার চাঁন মামুন ওরফে গ্যাড়পা হাজী, মশেতুল্লাহকে জীবিত অবস্থায় চোখ তুলে নিয়ে বহু নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে।
এ সময় যুবতীমেয়েদের উপর চরমভাবে নির্যাতন চালায়। ৮ এপ্রিল বিকালে সবচেয়ে বৃহৎ গণ হত্যার ঘটনা ঘটায় পাক সেনারা। রংপুর থেকে পাক সেনারা ট্রেনযোগে এসে পার্বতীপুর শহরের অবাঙ্গালীনেতা তৎকালীন এমপি কামরুজ্জামান ও শহরের নামকরা অবাঙ্গালী গুন্ডা বাচ্চু খান, নঈম খানের নেতৃত্বে নৃশংসভাবে প্রায় ৩/৪‘শ বাঙ্গালীকে গণহত্যা করে এবং ধর্ষিতা হয় অনেক মা বোন।
বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এলো ডিসেম্বর মাস। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশেষ প্রহরায় ট্রেন যোগে পার্বতীপুর থেকে প্রায় ৩৫ হাজার অবাঙ্গালী সৈয়দপুরে চলে যায়। ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর বোমা হামলায় পার্বতীপুরের তেলের ট্যাংকারে আগুন ধরে যায়।
১৪ ডিসেম্বর পার্বতীপুরের পাকসেনা ও রাজাকারদের ক্যাম্পগুলো আক্রন্ত হয়। এ অবস্থায় তারা পিছু হটে এবং ১৫ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় পার্বতীপুর। মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক বিজয়োল্লিসিত মানুষ পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে। শহরের মূল মূল ভবনগুলোতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পালন করছে বিস্তারিত কর্মসূচী।
সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধে পুস্পস্তক অর্পন, শহীদদের স্মরণে মিলাদ-মাহফিল, দোয়া-খায়ের আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সূত্র – পরিবর্তন।