তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক ।। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। ঐ বৎসর থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে।
মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হল: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। নোবেল পুরস্কারকে এ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদেরকে ইংরেজিতে নোবেল লরিয়েট বলা হয়।
সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর পূর্বে উইলের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় অসলো, নরওয়ে থেকে। বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে, কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। প্রত্যেক বছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেক একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই অর্থের পরিমান ছিল ৮০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনা। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এই পুরস্কার নিয়ে সারা বছরই সাধারণ মানুষের মাঝে চলে জল্পনা-কল্পনা। কে পাচ্ছেন এ বছরের নোবেল পুরস্কার, এ নিয়েও চলে তর্ক-বিতর্ক। এই যেমন গেল বছর সমন্বিতভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই এবং ভারতের কৈলাস সত্যারথি। মালালা ইউসুফজাই সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে এই স্বীকৃতি অর্জন করেন।
কিন্তু তার এই নোবেল প্রাপ্তি জন্ম দিয়েছে অনেক আলোচনা ও সমালোচনার। যাই হোক এই বিতর্ক আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। আজ আমরা জানব এমন দুজন কীর্তিমানের কথা যারা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হয়েও এই পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
জ-পল সাত্রে
সার্ত্রে কে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর দার্শনিক প্রতিফলন, সাহিত্যিক সৃজনশীলতা ,অক্লান্ত সাধনা এবং সক্রিয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার অর্জন তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয় । অস্তিত্ববাদ দর্শনের জনক হিসেবে ধরা হয় তাকে ।
সামাজিক প্রথাবিরোধী এই মানুষ টি জন্মেছিলেন ফ্রান্সে । শৈশবে বাবা হারান এবং পরবর্তী তে দূরত্ব তৈরী হয় মা’র দ্বিতীয় বিয়ের কারনে । কৈশর থেকেই দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন তিনি । ফলস্বরূপ পরবর্তী তে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ।
ফরাসী লেখক ও দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার এর সাথে তার সম্পর্ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল । স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত সাত্রে সত্য বলতে কখনও পিছু হটতেন না । অংশ নিয়েছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধে। ধরা পড়েছিলেন নাৎসী দের হাতেও । মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসে যোগ দেন হিটলার বিরোধী আন্দোলনে ।
অন্যায়ের বিরুদ্ধের আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকতেন, জনতার সাথে রাজপথেও নেমেছেন বহুবার । ১৯৬৮ সালে তিনি গ্রেফতার হন একটি আন্দোলন রত অবস্থায় । এর পর পর স্বয়ং ফরাসী প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল তাকে ছেড়ে দেবার আদেশ দেন এবং বলেন “ তোমরা ভলতেয়ার কে গ্রেফতার করতে পারো না”
১৯৬৪ সালে তাকে নোবেল পুরুষ্কার দেয়া হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখান করেন । ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যাক্তি যিনি এ কাজ করেন । শুধু নোবেল বলেই না, ১৯৪৫ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা লেজিওঁ দনর ও প্রত্যাখান করেন ।
১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর নোবেল পুরুষ্কার বিজয়ী দের নাম ঘোষনা করা হয় । যদিও ১৪ অক্টোবর নোবেল কমিটি বরাবর সাত্রে একটি চিঠি লেখেন যেন তার নাম মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় । তিনি চিঠি তে নোবেল কমিটি কে সতর্ক করে দেন এই বলে – যদি তাকে পুরুষ্কার দেয়াও হয় তা তিনি গ্রহন করবেন না । তার চিঠি টা কেউ পড়ে নি ।
তার এই প্রত্যাখান এর পর পরই এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সাত্রে তার অবস্থান স্পষ্ট করতে ২৩ অক্টোবর , অর্থ্যাৎ বিজয়ী দের নাম প্রকাশের একদিন পর ফরাসী একটি পত্রিকায় তার বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন তিনি কোন পুরুষ্কারে রূপান্তরিত হতে চান না । আরও বলেন ব্যাপার টা দূ:খজনক যে তার এই স্বীদ্ধান্ত অনেকে বিরূপ ভাবে গ্রহন করছেন। সাত্রে তার কাজের জন্য স্বরনীয় হতে চেয়েছিলেন, কোন পুরুষ্কারের জন্য নয় । পূর্ব এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতির একটি প্রতিদন্দ্বীতার ভেতরে তিনি কোন পক্ষ নিতে চান নি এই পুরুষ্কার গ্রহন করে । এছাড়া তার ভয় ছিল এই পুরুষ্কার তার লেখনী শক্তি কে স্তিমিত করবে । যদিও কোন সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না, তারপরও তার চিন্তা চেতনায় এর ছাপ দেখা যেত । প্রচন্ড ধূমপায়ী এবং এমফেটামিন আসক্ত সাত্রে জীবনের শেষ ভাগে প্রায় অন্ধ হয়ে যান । ১৯৮০ সালে এই মহান দার্শনিক মৃত্যুবরন করেন ।
লি ডাক থো
একজন ভিয়েতনামী বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিক । তরুন কমিউনিস্ট হিসেবে লে ডাক থো’র দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছিল লড়াই করার । তিনি কয়েক বার কারাবরন ও করেন । জাপান ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিয়েতনাম দখল করলে তিনি কমুনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে মনোনিত হন এবং দল কে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন ।
২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর হো চিন মিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন । কিন্তু ফরাসী সরকার কতৃক তারা আবার পরাধীন হয় এবং লো ডাক থো অন্যতম সামরিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লে ডাক থো এবং ইউএস নিরপত্তা উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জার প্যারিসে শান্তি আলোচনার নিমিত্তে বহুবার আলোচনায় বসেন । ১৯৭৩ সালের ২৩শে জানুয়ারী উভয়পক্ষ যুদ্ধবিরতি তে সম্মত হয় । কিন্তু রিচার্ড নিক্সনের আদেশক্রমে হ্যানয়ে ভয়ংকর ভাবে বোমাবর্ষন করা হয় যা বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাথর যুগের বর্বরতা এবং গনহত্যা হিসেবে বনর্না করা হয় ।
এরকম ক্রান্তিকালীন সময়ে আবার লে ডাক থো এবং হেনরী কিসিঞ্জার আলোচনায় বসেন এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি তে সম্মত হন । শান্তি আলোচনায় এই দুজনের ভূমিকার কথা চিন্তা করে নোবেল কমিটি ১৯৭৩ সালে লে ডাক থো এবং হেনরী কিসিঞ্জার কে শান্তি তে নোবেল পুরুষ্কারে ভূষিত করে । হেনরী কিসিঞ্জার নোবেল গ্রহন করলেও লে ডাক থো এ পুরুষ্কার প্রত্যাখ্যান করেন । কারন হিসেবে তিনি বলেন, ভিয়েতনামে এখনও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কিভাবে আমি নোবেল নেবো ? ১৯৯০ সালে এ মহান বিপ্লবী মৃত্যুবরন করেন ।-তথ্যসূত্র: বি.ফ ও ইন্টারনেট।