প্রাণখুলে হাসুন, আনন্দে বাঁচুন

hsiস্বাস্থ্য ও সচেতনতা ডেস্ক ।। রোগী গেলেন ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন হার্টের সমস্যা, কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, নিয়মমতো খাবেন। আর আপাতত কিছুদিন ভারী পরিশ্রম হয় এমন কাজগুলো করবেন না, অন্তত একমাস সিঁড়ি ভাঙা পুরোপুরি নিষেধ।
মাসখানেক পর রোগী পুনরায় গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সব দেখেশুনে বললেন, আপনার হার্টের অবস্থা আগের চেয়ে ভালোই মনে হচ্ছে, এখন আর সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে কোনো অসুবিধা নেই।
এই শুনে রোগী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ‘উফ্, বাঁচালেন ডাক্তার সাহেব, জলের পাইপ বেয়ে বাসায় ওঠা যে কী কষ্টের, এই কদিনে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি!’

জানি বলবেন, পুরনো কৌতুক। তা বটে। কিন্তু দরকার কী হাসি থামানোর? আপনি না হয় নতুন করেই হাসলেন। তাতে ক্ষতি নেই, বরং লাভ আছে ঢের। তাই হাসুন, প্রাণখুলে হাসুন। আনন্দে বাঁচুন।

হাসিতে সুস্বাস্থ্য, সুখনদ্রিা ও অটুট স্মৃতিশক্তি

সুস্বাস্থ্যের সর্বোত্তম দাওয়াই হতে পারে হাসি। খোদ চিকিৎসকরাই বলছেন এমন কথা। স্বাস্থ্যের ওপর হাসির প্রভাব নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডা. উইলিয়াম ফ্রাই। তার মতে, হাসি এক ধরনের ব্যায়ামের কাজ করে।

প্রাণবন্ত হাসির দমকে দমকে কেঁপে ওঠে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পেট ও মুখের পেশিগুলো। ফলে চমৎকার ব্যায়াম হয় এদের এবং পর্যাপ্ত রক্তসঞ্চালন ঘটে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছে যায় হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও বিভিন্ন পেশিতে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পাশাপাশি পাকস্থলীতেও রক্তসঞ্চালন বাড়ে। ফলে হজম প্রক্রিয়া ভালো হয়। স্বাস্থ্য-গবেষকরা তাই হাসিকে অভিহিত করেছেন ‘ইন্টারনাল জগিং’ হিসেবে।

ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিন্ডা ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের প্রফেসর ডা. লি ব্রেক বলেন, হাসি কখনো কখনো সত্যিকার ওষুধের মতোই কাজ করে। হাসিতে শিরা ও ধমনী-পথে রক্ত চলাচল সুষম হয়, ফলে দেহকোষে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ে। তাই শুধু নয়, রক্তনালীর, বিশেষত ধমনীর অযাচিত সংকোচন রোধেও হাসির রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজি পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, হাস্যপ্রবণ মানুষদের হৃৎস্বাস্থ্য তুলনামূলক ভালো থাকে।

হাসি আপনার শারীরিক মানসিক আবেগীয় স্বাস্থ্য ভালো রাখে। মনের বোঝা কমায়। আপনি কিছুটা হলেও ভারমুক্ত হন। তাতে সাইকো-সোমাটিক ডিজিজ বা মনোদৈহিক রোগে ভোগার আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই কমে। এছাড়াও টেনশনজনিত মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন নিরাময়ে হাসির ভূমিকা ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত।

হাসিখুশি থাকুন। অটুট থাকবে আপনার স্মৃতিশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স মেডিকেল স্কুলের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসি স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা বাড়ায়। সৃজনশীলতা হয়ে ওঠে শাণিত। সবসময় হাসিখুশি থাকেন এমন মানুষদের ওপর গবেষণা চালিয়েই মিলেছে এসব তথ্যপ্রমাণ।

হাসিতে ব্যথা উপশম

হাসি আপনার ব্যাথা ও শারীরিক যন্ত্রণার অনুভূতি কমায়। আনন্দময় প্রাণখোলা হাসিতে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয় এন্ডোরফিন, যা ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে দেয়। একবার প্রাণখোলা হাসি শরীরের মাংসপেশিকে শিথিল রাখতে পারে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ মিনিটের উচ্ছল হাসি পরবর্তী দু-ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথামুক্তির কাজ করতে পারে।

হাসি যে কেবল ছোটখাটো ব্যথার অনুভূতি কমায় তা নয়, স্প্যানিশ মেডিকেল জার্নাল র‌্যাবিস্তা দ্য এনফারমারিয়া-র একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পেশি ও হাড়ের দীর্ঘদিনের ব্যথা উপশমে হাসি হতে পারে এক দারুণ কার্যকরী ওষুধ।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

হাসুন। বাড়বে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সদা হাস্যময় ও উৎফুল্লচিত্ত থাকেন যারা, তাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে অধিকতর সংহত। দেখা গেছে, এ ধরনের মানুষের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান গামা ইন্টারফেরন ও টি সেল-এর কার্যকারিতা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। আর তাতে কমে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি। হাসিকে তাই ন্যাচারাল এন্টিবায়োটিক বা প্রাকৃতিক জীবাণুরোধী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

হাসির রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধী ক্ষমতা। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে ক্যান্সার সেল। কিন্তু তা টিউমারে রূপ নেয়ার আগেই আমাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ন্যাচারাল কিলার সেল ক্যান্সার সেলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিয়মিত হাসিতে ন্যাচারাল কিলার সেল-এর কার্যকারিতা বাড়ে।

রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যান্সার একবার হয়ে গেলে তা নিরাময়ে হাসির কোনো ভূমিকা আছে কি না, সেটি এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয় নি বটে, কিন্তু ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার উদ্যম যোগাতে পারে হাসি।

হাসুন, সুখী হবনে

হাসি আপনাকে সুখী করে। বাড়ায় আপনার ইতিবাচকতা বোধ। আপনাকে স্ট্রেস থেকে দূরে রাখে। জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। স্থায়ী করে আপনার আনন্দের অনুভূতি। আমাদের চারপাশের বন্ধু প্রিয়জন আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যাদের আমরা পছন্দ করি, যারা তুলনামূলক জনপ্রিয়, যাদের সঙ্গ আমাদের ভালো লাগে তাদের সবার একটি জায়গায় খুব মিল তারা হাসেন, জীবনের কোনো না কোনো কিছু নিয়ে তারা সবসময়ই থাকেন হাসিখুশি আর আনন্দ-উৎফুল্ল।

জীবন কখনোই একমাত্রিক নয়। জীবনে চলার পথে নানা উত্থানপতন আর বিচিত্র সব কারণে স্ট্রেস আসতেই পারে। কিন্তু সদানন্দ মানুষেরা খুব সহজেই এসব স্ট্রেস সামলে নিতে পারেন। আধুনিক ধারার স্বাস্থ্য-গবেষকরা তাই বলছেন, যাবতীয় স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হতে পারে হাসি।

কারণ, আমরা যখন নির্মল আনন্দে হেসে উঠি হোক তা যত তুচ্ছ কারণেই তখন কর্টিসোল আর এড্রিনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোনগুলোর প্রভাব কমে যায়। ফলে চাপ নিয়ন্ত্রণে আসে সহজেই।

আপনি হাসুন, হাসবে আপনার চারপাশ

দুঃখী নিপীড়িত মানুষের মাঝে জীবনভর হাসিমুখে সুখের ছোঁয়া বিলিয়ে গেছেন মহিয়সী মাদার তেরেসা। তার নিজের জীবনোপলব্ধি হাসি দিয়েই আমাদের সব সুখ আর আনন্দের শুরু। তাই হাসুন। সুখী হওয়ার জন্যে, মনের চাপ কমিয়ে আনন্দময় জীবনের জন্যে নির্মল আনন্দে হেসে উঠুন। মনের কোণে জমে থাকা রাগ ক্ষোভ দুঃখ হতাশা সহজেই প্রশমিত হবে।

ক্যালিফোর্নিয়ার পিপার্ডিন ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্ট প্রফেসর ড. স্টিভেন সুলতানফের পরামর্শ জীবনে হাসির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন, আপনার জীবন সত্যিই বদলে যাবে।

ভোরে, দিনের শুরুতেই, কোনো একটি সুখস্মৃতি মনে করে হেসে উঠুন। হাসি শুকরিয়ার প্রকাশ। কথায় বলে, মর্নিং শোজ দ্য ডে। তাই আপনি হাসুন, আপনার সাথে সাথে হেসে উঠবে অন্যরাও। হাসবে আপনার চারপাশ।

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*