গোপাল সিং, খোয়াই, ১৩ জুলাই ।। পৃথিবী আলোক শুভাশিত করে সূর্য্য যখন পূব আকাশে উদিত হয়, তখন কিন্তু চোখ জোড়া দৃঢ়ভাবে বুজে আমরা সুখ নিদ্রায় থাকি। সবাই নয়, অনেকেই। আবার অনেকেই ভোরের মিষ্টি বাতাস, পাখিদের কোলাহল, প্রাকৃতিক মনোরম নির্যাস, এই সকাল বেলাকে উপভোগ করেন। কতশত পাখিদের ডাক, কোলাহলপূর্ণ মতবিনিময়, সুশোভিত এক অলৌকিক জগতের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে ভাষা আমরা বুঝিনা, কিন্তু আনন্দ পাই। তবে বাঙালির বিভিন্ন রীতি-রীতির সাথেও জড়িয়ে রয়েছে এমন অনেক পাখির মধ্যে একটি হল ‘কাক’। কিন্তু কাক ডাকা, পাখি ডাকা ভোর বিলুপ্তির গহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলছে।
এদিন হঠাৎ করে খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেনী বিদ্যালয়ের মাঠে একদল কাক দেখে উৎসাহিত হয়ে পড়ি। এবং সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে রাখি। কে যানে, আবার কবে দেখা মিলবে তাদের! দেখা মিলবে কিনা সেও তো জানা নেই!
তবে কাক খুব ভাগ্যবান পাখী। কারন কাকের প্রতি আমাদের অপবাদ ও কাকের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া তাচ্ছিল্য আর উচ্ছিষ্ঠই কাককে এতকাল বিলুপ্তির পাখি হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। মানুষের অতি আদর পাওয়া সব পাখি শেষ পর্য্যন্ত মানুষেরই নিষ্ঠুরতায় মারা যায়। মরতে মরতে একসময় বিলুপ্ত হয়। যেমনটা হয়েছে চড়ুই পাখির বেলায়। হাম-দর্দের মত বড় বড় প্রতিষ্ঠান ‘চড়ুইয়ের’ মাথা দিয়ে ওষুধ বানানো শুরু করায় পাখিপ্রেমীদের তালিকা থেকে ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেছে চড়ুই পাখি। কাক যদি প্রিয় হতো তবে কবেই এরও দশা এমনই হতো। সেক্ষেত্রে কাক বেঁচে গেছে বহুকাল। অথচ ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার ক্রিস্টোফার বার্ড এর মতে ‘কাক বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে বনমানুষ তথা অ্যাপস-এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দী’।
কিন্তু আজ মানুষ পশু-পাখির আবাস-স্থল দখল করেছে। অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কেটে বন-জঙ্গল উজার করছে। আর বাঁচার তাগিদে নিরীহ পশু-পাখিরা মানব বসতিতে এসে জানান দিচ্ছে তারা মাথা গুঁজার ঠাইটুকু হারিয়ে বসেছে। তাদেরও বাঁচা দরকার। তাদের মৌলিক অধিকার, কর্তব্য থাকা কি বাঞ্ছনীয় নয়? তাদের ভুবনেই তো আমরা শুধু ঠাঁই করিনি, কৌশলে ছিনিয়ে নিয়েছি। শত বছরের ইংরেজের শাসনকে যখন আমরা সইতে না পেরে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম-আত্মাহুতি দিয়ে, ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সেখানে লড়াইয়ের জন্য কোন কিছুই তো নেই তাদের কাছে। না আছে বল, না কৌশল, না বিচার-বুদ্ধি। তাদের ছাড়াতো পৃথিবীটাই তার ভারসাম্য হারাতে বসেছে। তবুও কি তাদের জন্য কিছুই করার নেই!
কিছু করছিনা বলেই তো আর কাক ডাকা পাখি আমাদের চারপাশ থেকে নিশ্চিহ্ন। কতদিন হলো দেখিনা বাঁশ বাগানে, আমের ডালে, ঝোপঝাড়ে পাখিদের আনাগুনা। কাক, কোকিল, শালিক, চড়ুই, টিয়া-ময়না, দোয়েল, টুনটুনিদের। লক্ষীপেঁচাও তো নেই! নেই ডাহুক, বক, মাছরাঙ্গা, শকুন, চিল, বাজপাখি। ঘুঘু পাখি সহ এমন অনেক অজানা পাখি আজ নিশ্চিহ্ন। যাদের চেহারাই ছিল আমাদের কাছে তাদের একমাত্র পরিচয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে বৈরী আবাহওয়া, কীটনাশক ব্যবহার বৃদ্ধি, পাখিদের আবাস স্থল ও খাদ্য সংকট, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন এবং পাখি শিকারীদের আগ্রসনই আজ পাখিদের বিলুপ্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই খুব শীঘ্রই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। নয়তো পাখিরা কেবলই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে চির বিলুপ্তির পথে ধাবিত হবে। ‘কাকে’র কর্কশ, শুভ-অশুভতার অনুচিৎ যুক্তিকে পেছনে ফেলে দূষন মুক্ত সচেতন সমাজ গড়ার দিকে আমাদের সবাইকে অচিরেই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই হয়তো এদেরকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষিত হবে।