পাঁচ বছর বাদে ‘সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প’ চালু হতে যাচ্ছে খোয়াইতে

khগোপাল সিং, খোয়াই, ২৬ জুলাই ।। নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রনালয়, ভারত সরকার কর্তৃক ‘সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প’ চালু হয় ২০০৯ সালে। ত্রিপুরা, আসাম, অরুনাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড ও জম্মু-কাশ্মীর-এ এই প্রকল্প চালু হয় ২০১০ সালে। এই মর্মে ৩০শে নভেম্বর ২০১০ ইং তারিখে আগরতলায় একটি মৌ-স্বাক্ষরিত হয়। রাজ্যের সমাজ কল্যান ও সমাজ সুরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী বিজিতা নাথ মৌ-স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রাজ্যে অধিকাংশ জেলাতেই এই প্রকল্প চালু করেন। এই প্রকল্পাধীন দুটি সুবিধা রয়েছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘স্পনশরসিপ এন্ড ফষ্টার কেয়ার’ বা অনাথ শিশুদের জন্য এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘এডপশন এন আফটার কেয়ার’ বা শিশুর পরিবারের বার্ষিক আয়ের নিরীখে। কিন্তু দু:খজনক ঘটনা হলো শিশুদের জন্য এই ধরনের সুসংহত প্রকল্প’র আওতা থেকে বঞ্চিত ছিল খোয়াই জেলা। জেলার শিশুরা পাঁচ বছরের উপর এই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত থাকার পর যদিও টনক নড়ে রাজ্য শিশু উন্নয়ন দপ্তরের, কিন্তু প্রকল্পের দুটি সুবিধার মধ্যে একটি মাত্র সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে খোয়াই জেলায়। এই প্রকল্প চালু হলেও সঠিক কোন দিশা-নির্দেশ না থাকায় হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন দু:স্থ শিশুদের পিতা-মাতারা। বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা। এমনকি খোয়াই জেলা সমাজ কল্যান দপ্তরের আধিকারিকরাও সঠিক কোন তথ্য দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন। যে কারনে আজ একটু বিস্তৃত তথ্যমূলক সংবাদ পরিবেশিত করতে হচ্ছে। বিস্তর অভিযোগে যাওয়ার আগে একটু চোখ রাখব প্রকল্পের মোটামুটি একটা স্ট্রাকচার বা পরিকাঠামোর দিকে :
কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করার ক্ষেত্রে ফান্ড কিভাবে আসছে? (*গাইড লাইন অনুসারে)
কেন্দ্রীয় সরকার মোট বরাদ্দের ৯০% দিচ্ছে > রাজ্য সরকার দিচ্ছে ১০%। 
যদি সেটা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হতো সেক্ষেত্রে –
কেন্দ্রীয় সরকার : ৯০% বরাদ্দ > এনজিও : ১০% > রাজ্য সরকার : ০% (কোন কিছুই দিতে হতো না)। 
রাজ্য সরকার কত টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে? (*গাইড লাইন অনুসারে)
যে রাজ্যে ১৫টির নীচে জেলা আছে সেই রাজ্যে জেলা পিছু > ১৫ লক্ষ টাকা
যে রাজ্যে ১৫টির বেশী জেলা আছে সেই রাজ্যে জেলা পিছু > ৩০ লক্ষ টাকা
যে রাজ্যে ৩০টির বেশী জেলা আছে সেই রাজ্যে জেলা পিছু > ৪৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পাবে। (কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে সেই বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বাড়তে পারে। কারন লক্ষ্য ‘সুসংহত শিশু সুরক্ষা’।)
নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রনালয়, ভারত সরকার থেকে বরাদ্দ অর্থ আসার পর সেটা কিভাবে বন্টন হয় : (*কেন্দ্রীয় গাইড লাইন অনুসারে)
কেন্দ্র (বরাদ্দ অর্থ + রাজ্য সরকারের ১০% যুক্ত হয়ে) > রাজ্য (১৫ দিনের মধ্যে) > রাজ্য শিশু উন্নয়ন সোসাইটি (১৫ দিনের মধ্যে) > জেলা শিশু উন্নয়ন ইউনিটস এর কাছে পৌছবে। এই বরাদ্দ থেকে অন্য কোন খাতে খরচ করার বিধান নেই (*কেন্দ্রীয় গাইড লাইন অনুসারে)। 
কে কিভাবে এই প্রকল্পের টাকা পাবেন? (*কেন্দ্রীয় গাইড লাইন অনুসারে)
মেট্রো শহরে > পরিবার পিছু বাৎসরিক যায় > ৩৬ হাজারের নীচে যাদের।
অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে > পরিবার পিছু বাৎসরিক আয় > ৩০ হাজারের নীচে এবং 
গ্রামীন এলাকার ক্ষেত্রে > পরিবার পিছু বাৎসরিক আয় > ২৪ হাজার টাকার নীচে যাদের, তারাই এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে প্রতিটি শিশুকে প্রত্যহ স্কুলে যেতে হবে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারলেই এই প্রকল্পের সুবিধা মিলবে নতুবা তা বাতিলও হতে পারে (*কেন্দ্রীয় গাইড লাইন অনুসারে : পৃ-৪৯/এইট/ইলাভেন)। 
তাই এই প্রকল্পের সুবিধা প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যেন পেতে পারে, তার জন্য –
রাজ্য > জেলা > ব্লক > গ্রাম স্তর এভাবে বিভিন্ন কমিটি থাকবে, যারা এই প্রকল্পটি পচিরালনা করবেন। জেলার ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি পরিচালনা করবেন জেলা শাসক (কমিটির চেয়ারপার্সন), তারপর রয়েছেন সহকারী-জেলা শাসক (ভাইস-চেয়ারপার্সন)। এছাড়া এই প্রকল্পটি সঠিক বাস্তবায়নের জন্য জেলার এই কমিটিতে সদস্য হিসাবে থাকছেন এসপি, জেলা পঞ্চায়েত আধিকারিক, জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক, জেলা শ্রম আধিকারিক সহ অন্যান্য সদস্যরা।
এই গেল আপাতত একটা ধারনা। কিন্তু এই এতটুকু ধারনাই দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন খোয়াই সমাজ কল্যান দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তারা। এই প্রকল্প নিয়ে জনগন দিশেহারা। এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে খোয়াই মহকুমা শাসক, সমাজ কল্যান দপ্তর এবং জেলা ইন্সপেক্টরের কাছে গিয়েও নানা জনে নানা মত প্রকাশ পায়। তারপর জানা যায় ২০১০ সালে এই প্রকল্প চালু হবার বিষয়টি। প্রকল্পটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি হচ্ছে অনাথ শিশুদের জন্য। এক্ষেত্রে যে শিশুদের মা আছে বাবা নেই, অথবা বাবা আছে মা নেই, বা কেউই নেই। অন্য পরিবারের লালিত-পালিত হচ্ছে এবং শিশুটি যদি প্রতিদিন স্কুলে যায়। তবে সে মাসে ২ হাজার টাকা করে ৩ বৎসর পর্য্ন্ত পাবে। সেই টাকা ব্যাঙ্কে জমা থাকবে। শিশুটির বয়স ১৮ বছর সম্পূর্ন হলে জমাকৃত টাকা সে পাবে। জমাকৃত প্রায় ৭২ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে সুদ সহ শিশুটির ১৮ বছর বয়সে কত দাঁড়াবে তা বলা না গেলেও, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের জন্য ঐ শিশুটির আগামী দিনের উন্নত পড়াশুনার জন্য বা তার ভবিষ্যত গড়ার ক্ষেত্রে কার্য্কর প্রমানিত হবেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শহর এবং গ্রামের শিশুদের পরিবারের বাৎসরিক আয়ের নিরীখে নিয়মানুযায়ী একই ভাবে মাসে ২ হাজার টাকা করে ৩ বছর পর্য্ন্ত প্রদান করা হয়। বর্তমানে খোয়াই জেলার অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীরা বাড়ী বাড়ী প্রচার চালাচ্ছেন ‘সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে’র বিষয়ে। কিন্তু নিয়ম-নীতি সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন নি। যেহেতু আমলারাই প্রকল্প সম্বন্ধে ধূঁয়াশায়, তাই অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীদের এ বিষয়ে জ্ঞান কতটুকু থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এনিয়ে খোয়াই এর জনসাধারনের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। তার মধ্যে প্রকল্পটি পাইয়ে দিতে খোয়াই অফিসটিলা চত্বরে বিভিন্ন দালালরা সক্রিয়। কারন প্রকল্প পেতে সাধারন মানুষ যাচ্ছেন ইনকাম সার্টিফিকেট নিতে। এখন পর্য্ন্ত সাড়ে নয় হাজার আবেদন জমা পড়েছে। কিছু জনগন ইনকাম পেয়েও গেছেন। কিন্তু যখন ইনকাম সার্টিফিকেট খোয়াই জেলা সমাজ কল্যান দপ্তরে জমা করতে যান, তখন বলা হয় প্রথম প্রকল্পটির কথা। অর্থাৎ অনাথ শিশুদের স্কিমের কথা। কেবল মাত্র অনাথ শিশুরাই নাকি সুবিধা পাবে। অন্যরা পাবে না। অথচ প্রকল্পটি দুটি ভাগে বিভক্ত। দ্বিতীয় প্রকল্পের সুবিধা তারা পেতেই পারে। কিন্তু সরকারী কর্মচারীরা জনগনকে হয়রান করছে বলেই অভিযোগ জনসাধারনের। প্রশ্ন উঠছে প্রকল্পটি ২০১০ সালে ত্রিপুরা রাজ্যে চালু হলেও কেন ৫ বছর সময় লাগলো খোয়াই জেলায় চালু হতে। আমলারা অনেকেই বলেন কিভাবে ৫ বছর? খোয়াই জেলা হলো কবে? কিন্তু আমলা-কর্তা বাবুরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন খোয়াই জেলা সদ্য হলেও বিগত সময়ে পশ্চিম জেলার অধীন তো ছিল। তবে কেন পশ্চিম জেলাতে এই প্রকল্প চালু হয়নি। বা হলেও কেন খোয়াই মহকুমার শিশুরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো? খোয়াই জেলা সমাজ কল্যান দপ্তর থেকে জানা যায় এই প্রকল্প খাতে ২০ লক্ষ টাকা এসেছে। তারপরও কেন একটি প্রকল্পের নামে জনসাধারনকে বোকা বানানো হচ্ছে, প্রশ্ন জনমনে। প্রকল্প নিয়ে ধুঁয়াশা, আমলা-কর্তাদের মধ্যে ধূঁয়াশার মধ্যে ‘সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প’ অন্তরালে চলে যাবে নাতো! প্রশাসনকে এবিষয়ে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানিয়েছেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষ, প্রকৃত সুবিধাভোগীরা। সর্বোপরী শিশুরা যেন এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে জীবনের লড়াই-সংগ্রামে আরোও এগিয়ে যেতে পারে। সুসংহত হতে পারে। শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে। এই লক্ষ্যেই আমাদের অবিচল থাকতে হবে।

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*