গোপাল সিং, খোয়াই, ১২ আগষ্ট ।। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতা এমনিতেই আসেনি। তারজন্য অনেক রক্ত ঝড়েছে, অনেককেই আত্মবলিদান দিতে হয়েছে। একদিকে গুলির লড়াই, অন্যদিকে অহিংস আন্দোলন, এসবের মধ্য দিয়েই একদিন আমাদের মাটি-আকাশ-বাতাস মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামী কিংবা তাদের পরিবার কি হালে রয়েছে, তার খোঁজ ক’জন রাখেন? এমনই এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারের বেহাল অবস্থা ফুটে উঠল খোয়াইতে।
খোয়াইয়ের চরগনকী নিবাসী প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী উদ্ধব চন্দ্র রায়। উনার জন্ম ৪ঠা মে ১৯১৪ ইং সনে। তিনি পরাধীন ভারতের দুরাবস্থা দেখেছেন। তিনি ছেলেবেলা থেকেই পরাধীনতার কালো অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে দেশের অন্যান্য বিপ্লবীদের ধ্যান-ধারনায় উদ্বুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমে পড়েছিলেন। তারপর ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট-এর সেই স্বর্ণালী দিন। স্বাধীন ভারতের মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া ছিল এক অমোঘ স্বস্তির মুহুর্ত। কিন্তু যারা ভারতকে স্বাধীন করতে রক্ত ঝড়িয়েছিলেন তাদের ক’জনকে আমরা চিনতে পেরেছি, জানতে পেরেছি। তবে যারা দেশকে স্বাধীন করতে নিজেদের বুক পেতে দিয়েছিলেন, যারা স্বাধীনোত্তর ভারতে জীবিতাবস্থায় ছিলেন তাদের কিন্তু সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাদের ও তাদের পরিবারের জন্যও পেনশন চালু আছে এদেশে।
অথচ আজ এক বৎসর যাবত সেই পেনশন থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিধবা পত্নী ও তার পরিবার। সরকারি অকর্মন্য কর্মচারীদের টালবাহানায় বন্ধ হয়ে আছে প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী উদ্ধব চন্দ্র রায় এর পেনশন। উনার স্ত্রী প্রভাসিনী রায় পেনশন থেকে বঞ্চিতই শুধু নয়, বিগত এক বছর যাবত হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন। প্রভাসিনী দেবী নিজেই জানালেন উনার দু:খের কথা। একসময় উনার কাছ থেকে পেনশন বুকের আসল কপি খোয়াই সাব ট্রেজারী থেকে আগরতলা ট্রেজারী পাঠানো হয়। ৭৮ উর্দ্ধ বয়স্কা প্রভাসিনী দেবী বারবার আগরতলা ট্রেজারী ছুটে যান। অথচ আগরতলা ট্রেজারীর কর্মকর্তা সাফ বলে দেন, উনারা পেনশন বুক পায়নি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামী উদ্ধব চন্দ্র রায়ের বিধবা পত্নীর পেনশন বুকটি উনার টেবিলেই পড়ে পড়ে আছে বলে জানা যায়। আকার ইঙ্গিতে ট্রেজারী কর্মকর্তা ঘুষ চাইলেও প্রভাসিনী দেবী সেই সাঙ্কেতিক ভাষা বোঝে উঠতে পারেন নি। যার ফলে এক বছর যাবত পেনশন থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিধবা পত্নী প্রভাসিনী রায়।
অথচ উনার ৫ জনের পরিবার বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। একমাত্র ছেলে বর্তমানে ভাড়া করা টমটম অটো রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। খুবই আশ্চর্য্য্যজনকভাবে সেলুকাসের দেশে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার পেনশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উদ্ধব চন্দ্র রায়, যার একসময় খোয়াইতে বেশ সুনাম ছিল। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী শচিন্দ্রলাল সিংহের সাথে উনার যোগাযোগ ছিল। খোয়াইতে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী শচিন্দ্রলাল সিংহ বা সুখময় সেনগুপ্ত’র সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য পেনশন ভাতা চালু করলে, ১৯৮০ সাল থেকে তিনি এই সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে উদ্ধব চন্দ্র রায়ের প্রয়ানে উনার স্ত্রী প্রভাসিণী রায় সেই সুবিধা পেতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারটি কেন্দ্রীয় ভাতার পাশাপাশি রাজ্য সরকার প্রদত্ত ৫০০ টাকা ভাতাও পেতেন। কিন্তু কতিপয় অসাধু সরকারী কর্মচারীদের জন্য বরাবরই রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে বদনামের ভাগিদার হতে হয়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হলোনা। বর্তমানে যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার মাসিক ১৬ হাজার টাকা পেনশন পাওয়ার কথা, সেখানে এক বছর যাবত বন্ধ হয়ে আছে সেই পেনশন ও ভাতা। আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্যেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে পরিবারটি। কিন্তু স্বাধীণতা সংগ্রামীর পরিবারের এই দূরাবস্থার দায়ভার কে নেবে? দেশের জন্য যারা জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে নেমেছিল একদিন, তাদের পরিবারের যদি এই অবস্থা হয় তবে আগামী প্রজন্ম কি শিক্ষা নেবে? প্রশ্ন বুদ্ধিজীবি মহলের।