গোপাল সিং, খোয়াই, ৩০ সেপ্টেম্বর ।। খোয়াই জেলার আশারাম বাড়ী এলাকায় ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বশেষ সীমান্ত বংশীরাম বাড়ী এডিসি ভিলেজ। ভিলেজ এলাকার করুন দশা। জল-রাস্তা-ঘাট-বিদ্যুৎ-শিক্ষা এবং রোজগার, সব দিক দিয়েই ভিলেজের সাধারন মানুষের হাত শূণ্য। ভিলেজের উপজাতি অংশের মানুষের অবস্থা তথৈবচ। বেশীর ভাগ পরিবারেরই নুন আনতে পান্থা ফুরোয় অবস্থা। তবে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থীতিশীল তারা সবাই শহরমুখী। কিন্তু বাদ বাকী অধিকাংশ পরিবারেরই দৈন্যদশা। বংশীরাম বাড়ীর এক হীন দরিদ্র্য পরিবার এর করুন কাহিনী এই দৈন্যদশার জ্বলজ্যান্ত সাক্ষ্য বহন করছে।
২৯শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নাগাদ ভিলেজেরই ৬৫ উর্দ্ধ এক প্রৌঢ় নিজের ছেড়া গামছা দিয়ে উর্দ্ধমুখী হলেন। উপেন্দ্র দেববর্মা নাম উনার। উপেন্দ্র বাবুর তিন ছেলে দুই মেয়ে। খুবই করুন দশা পরিবারের। ছেলে-মেয়েরা বাঁশের কুরুল সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে সংসার প্রতিপালন করেন। পরিবারের কেউই ঠিক-ঠাক বাংলা বলতে পারেন না। তবে করুন কাহিনীর ভাষা এক, দু:খের সুর এক। তাই এলোমেলোভাবেই পরিবারের লোকজন এদিন তুলে ধরলেন তাদের পরিবারের এক দুখদ কাহিনী। জানালেন মৃত উপেন্দ্র দেববর্মা দীর্ঘ্যদিন যাবত অসুস্থ্য ছিলেন। রক্ত বমিও হচ্ছিল। চিকিৎসার জন্য এম.পি.ডাব্লিউ’র সাথে কথা বললে, তিনি বেহালাবাড়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাবার পরামর্শ দেন। বহু কষ্টের মধ্যেই ৬৫ উর্দ্ধ উপেন্দ্র বাবুকে বেহলাবাড়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখান থেকে উনাকে খোয়াই জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে এখান থেকে ওখানে যাতায়াতের যে সমস্যা, সেই সমস্যার মধ্যে উপন্দ্রে বাবু আর খোয়াই জেলা হাসপাতালে যেতে রাজী হননি। বরং দ্বারস্থ হলেন ওঝা, বৈদ্য, ঝাড়-ফুঁক-এর। অথচ বর্তমানে টিবি রোগীর জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা চালু আছে দেশে। টিবি রোগীদের জন্য চিকিৎসা, ওষুধ এমনকি খাবারও বিনামূল্যে দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কিছুইতো জুটলনা উপেন্দ্র বাবুর। অথচ লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকা ব্যায় হচ্ছে বিজ্ঞাপন-এর জন্য। কিন্তু আসল কাজটা হচ্ছে কি? কোথায় জনসচেতনতা? যদি তাই হতো, তবে কি উপেন্দ্র দেববর্মাকে ৬৫ বছরে পা রেখে এভাবে উর্দ্ধমূখী হতে হতো? টিবি রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে যে হয় তা কি জানতেন উপেন্দ্র বাবু? এখনোও তা জেনে উঠতে পেরেছে কি উনার দরীদ্র্য পরিবারটি? যদি কোনও দিন জানতে পারেন তবে কি ভাবমূর্ত্তি গড়ে উঠবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের? বদনাম কি হবে না রাজ্য সরকারের?
সে যাইহোক এখন যে প্রশ্নটা সবচাইতে বেশী উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে সেটা হল, কেন উপেন্দ্র দেববর্মা উন্নততর চিকিৎসা নিতে চাননি? তিনি কি শুধুমাত্র পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা ও নিজের অসাহয়ত্বের কারনেই উন্নত চিকিৎসা নিতে চাননি? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে ছিল অন্য কোন চিন্তা-ভাবনা, দু:খ-বেদনা ! হয়তো নুন আনতে পান্থা ফুরোয় অবস্থার মধ্য দিয়ে যে পরিবারকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে সেই পরিবারের উপর চিকিৎসার ব্যায়ভার চাপিয়ে দিতে চাননি উপেন্দ্র বাবু।
প্রতিবেদক নিজেই তা অনুধাবন করতে পেরেছেন। একটা সহজ হিসেব এর সমাধান সূত্র বের করে দিতে যথেষ্ট ছিল। দেখা যায় বংশীরাম বাড়ী থেকে যদি খোয়াই জেলা হাসপাতালে আসতে হয় তবে গাড়ী ভাড়া খরচ হবে দু’শ থেকে আড়াইশ টাকা। উপেন্দ্র দেববর্মার পরিবার যেখানে বাঁশের কুরুল বিক্রি করে দিন গুজারা করে সেখানে এই অর্থের জোগার তারা কিভাবে এবং কোত্থেকে করবে, এই প্রশ্নটাই হয়তো উপেন্দ্র বাবুকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছিল সেদিন। আর এই চাপা দু:খ আর টিবি রোগ নিয়ে যন্ত্রনায় ছটপট করা ছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা ছিলনা উপেন্দ্র দেববর্মার। হয়তো সে কারনেই নিজের পড়নের ছেঁড়া গামছাটাকেই কাছে টেনে নিয়ে উর্দ্ধমুখী হলেন ৬৫ উর্দ্ধ এই প্রৌঢ়। কি অসহ্য যন্ত্রনা বুকে নিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। অভিমানি কণ্ঠে যেন বলছিলেন, পাড়ার কিংবা গ্রামের কোন সৎ লোক একটু হাত বাড়িয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসল না ! কি অভিমান বুকে বিঁধেছিল সেদিন ! ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গান এর কথা ‘মানুষ মানুষের জন্য…’ মনে পড়ে যায়। সেই ভাবাবেগে কেউ ভাসতে পারেনি আজও। একটু সাহায্য, একটু সহানুভুতিই তো চেয়েছিলেন উপেন্দ্র বাবু। কিন্তু কি পেলেন?
দু:খজনক ঘটনা চাম্পাহাওড় থানা-পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে যায়, তখন উপেন্দ্র দেববর্মার মৃতদেহ খোয়াই জেলা হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠাতে যে লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তা সত্যিই এরাজ্যে বিরল থেকে বিরলতম ঘটনায় স্থান করে নেয়। মৃতদেহটিকে নিয়ে আসার জন্য গ্রামবাসী বা কোন ব্যাক্তিই এগিয়ে আসেনি। মৃত উপন্দ্রে বাবুর পরিবারের হাতে সেদিন মাত্র একশত টাকাই ছিল। এই অবস্থায় চাম্পাহাওড় থানার পুলিশ নিজেরাই মৃতদেহটি হাসপাতালে নিয়ে আসে। ময়না তদন্তের পর মৃতদেহটি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু মৃতদেহ সৎকারের জন্য যে মাত্র একশ টাকা ছাড়া আর একটিও কানাকড়ি ছিলনা পরিবারের হাতে। পরিবারের লোকজন বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এবিষয়ে চাম্পাহাওড় থানার পুলিশ বেহলাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী, বিত্তশালী ব্যাক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেও সাহায্যের জন্য কাউকেই পাননি। বাধ্য হয়ে পুলিশ কর্মীরাই মিলে মিশে সাতশ টাকা গাড়ী ভাড়া এবং নগদ চার-পাঁচশ টাকা তুলে দেন অসহায় পরিবারের হাতে। কি লজ্জাজনক কাহিনী। আধুনিকতার নামে মানুষ এখন ঘর বন্দী জীব। মোবাইল আর সোশাল মিডিয়ায় মজে থাকা রোবট-এ পরিনত। যারা জীবিতাবস্থায় এক বৃদ্ধের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেনি তারা মৃতদেহ সৎকারে কেন এগিয়ে আসবে? বোঝা উচিত ছিল অসহায়, দরিদ্র্য পরিবারকে, পুলিশকে। বেদনাদায়ক এই মুহুর্তে গোটা পরিবারটিই বাকরুদ্ধ।
অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই এলাকার নেতা বাবুদের। কারন উনারা তো শহরমুখী। শহরে বসে রাজনীতি করেন। এলাকার কোন নেতা তার মেয়ের জামাইকে গাড়ী উপহার দেবে, কেউ প্রয়াত জননতা দশরথ দেব-এর উপর গবেষনা করবে। শহরে বসে ফ্ল্যাশ লাইটে মিডিয়ার নজর কাড়তে প্রয়াত জননেতা দশরথ দেব-এর চিন্তাধারা, উনার আদর্শে চলার কথা বলবে। আবার শহরে বসে কেউ কেউ তিপ্রাল্যান্ডের দাবি তুলবে। এসবের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে জননেতা দশরথ দেব-এর দেখা স্বপ্নগুলো। উনার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামে-পাহাড়ে, ভাঙা ঘরে, শুকনো খেতে, স্তব্ধ পানীয় জলের উৎসে কিংবা অন্ধকারে দশরথ দেব-এর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম উনার চিন্তা-ধারাকে প্রতিফলিত করতে পারলেই সমস্ত গবেষনা, সমস্ত কর্মসূচী কার্যত সফল হবে।