কুঁড়েঘর থেকে বিশ্বজয়ের গল্প ম্যারাডোনার

খেলাধুলা ডেস্ক ।। কেমন ছিল সেদিনের আকাশ? সূর্যের তেজ? প্রকৃতি কি তার আগমনী বার্তার কথা আগেই জানান দিয়েছিল? যে, তিনি আসছেন। ফুটবলবিশ্বের বড় একটা উপহার। পরবর্তীতে যিনি হয়ে উঠবেন ফুটবলেরই সর্বকালের সেরাদের একজন। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর; আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের লানুসবাসী কি বুঝতে পেরেছিল, সেদিন হতদরিদ্র একটি পরিবারে ভূমিষ্ঠ নবাগত অতিথিটির নামেই একদিন পরিচিত হবে এই শহর? যার নাম তারা রেখেছিল- ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা ফ্রাঙ্কো। ম্যারাডোনার জন্মস্থানটি ছিল লানুসের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতাল। পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের একজন। প্রায় একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে কিংবদন্তি হয়েছেন। জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার পর কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পেলের সঙ্গে যৌথভাবে ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। শুরুতে মাত্র ১০ বছর বয়সে এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলার সময় একজন স্কাউট তার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন এরপরই। যদিও ১২ বছর বয়সে বলবয় হিসেবে প্রথম বিভাগের খেলার মধ্যবিরতির সময় বল দিয়ে জাদুকরী নৈপুণ্য দেখিয়ে দর্শক-বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ট হতে হয়েছিল তাকে। তারপর শুধুই এগিয়ে চলার গল্প। বার্সেলোনায় ৫ মিলিয়ন ইউরো ও নাপোলিতে ৬.৯ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার ফি’র তৎকালীন রেকর্ড ছিল তার দখলে। পেশাদার ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া ও নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। ক্লাব পর্যায়ের সোনালী সময় কাটিয়েছেন ইতালির নাপোলিতে। আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে ২৪ ম্যাচে ১৩ গোল ও মূল দলের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল করেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে ৪টি ফিফা বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে দলকে বিশ্বকাপ জেতান এবং সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল জেতেন। ঐ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলের জয়ে করা দুটি গোলের প্রথমটি ‘হ্যান্ড অফ গড’ নামে বিখ্যাত; আর দ্বিতীয়টির পথে প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে জাল খুঁজে নিয়েছিলেন, যেটি দর্শকদের ভোটে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ম্যারাডোনা আলবিসেলেস্তাদের হয়ে অভিষেক হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ১৬ বছর বয়সে, প্রতিপক্ষ ছিল হাঙ্গেরি। ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে আর্জেন্টিনাকে ফিফা যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতান। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ (১৯৭৯) ও ফিফা বিশ্বকাপে (১৯৮৬) গোল্ডেন বল জেতার রেকর্ড করেছিলেন তিনি। প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি এসেছিল ১৯৭৯ সালের ২ জুন, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৮২ বিশ্বকাপ ছিল ম্যারাডোনার প্রথম বিশ্ব আসর। সেবার অনুজ্জ্বল থাকলেও ১৯৮৬ বিশ্বকাপে সেটা পুষিয়ে দেন। আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিতেই অবদান ছিল তার। এরপর আসে ১৯৯০ বিশ্বকাপ। তবে গোড়ালির চোট সমস্যায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। পশ্চিম জার্মানির কাছে বিতর্কিত পেনাল্টিতে শিরোপা হারায় ম্যারাডোনার দল। এরপর ১৯৯৪ বিশ্বকাপে মাত্র দুই ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন ডোপিং বিতর্কে তাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর্জেন্টিনাও দ্বিতীয় পর্ব থেকে বিদায় নেয়। এরপর ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। ঘরোয়া ফুটবলে প্রতি ম্যাচে ম্যারাডোনার গোল গড় ০.৫২৬। আর্জেন্টিনার হয়ে টানা ২১টি ম্যাচে মাঠে নামার রেকর্ড আছে তার। বিশ্বকাপের রেকর্ড ১৬ ম্যাচে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচে ৮ গোলের পিঠে ৮টি গোলে সহায়তা করেছেন। মাদক বিতর্ক ছাড়াও আরেকটি অপূর্ণতা আছে ম্যারাডোনার। দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতা হয়নি এ ফুটবল কিংবদন্তীর। ক্যারিয়ারে কলঙ্কের দাগও আছে ম্যারাডোনার। ১৯৯১ সালে ইতালিতে ড্রাগ টেস্টে কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়ার পর ১৫ মাসের জন্য ফুটবলে নিষিদ্ধ ছিলেন। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে এফিড্রিন টেস্টে ফল বিপক্ষে যাওয়ায় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েন। তবে ২০০৫ সালে মাদক ত্যাগ করে মৃত্যুর কোল থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। কোকেন সেবনে ম্যারাডোনা মায়োকার্ডিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছেন। এক সময় তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণেও রাখতে হয়েছিল। ২০০৭ সালের তাকে হেপাটাইটিস এবং অ্যালকোহলের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অ্যালকোহল সম্পর্কিত সমস্যার কারণে একটি মানসিক ক্লিনিকে স্থানান্তরের দরকারও পরেছিল তার। ঐ বছরই আর্জেন্টিনীয় টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ম্যারাডোনা ঘোষণা দেন যে- আড়াই বছর যাবত মাদক ব্যবহার থেকে বিরত আছেন তিনি। খেলোয়াড়ি জীবনের পর প্রথমে ২০০৫ সালে খেলাধুলা বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বোকা জুনিয়র্সে ফেরেন ম্যারাডোনা। তিনি আল্ফেও বাসিলকে বোকার হিসেবে নিয়ে আসেন। বদলে যায় বোকা জুনিয়র্সের চিত্র। বোকা ২০০৫ আপের্তুরা, ২০০৬ ক্লাউসুরা, ২০০৫ কোপা সুদামেরিকানা, ২০০৫ রিকোপা সুদামেরিকানা জেতে। এরপর পুরােদস্তুর কোচিংয়ে জড়ান ম্যারাডোনা। প্রথমে সহ-কোচ হিসেবে টেক্সতিল মান্দিইউ এবং রেসিং ক্লাবের কাজ করেন। পরে দুবাইয়ের ক্লাব আল ওয়াসলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন। সফলতা না পাওয়ায় অবশ্য এক বছরের মাথাতেই বরখাস্ত হন। মাঝে ২০০৯ সালে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পান তিনি। ম্যারাডোনার অধীনে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ দুই ম্যাচ জিতে বিশ্ব আসরে অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু ২০১০ বিশ্বকাপে জয় দিয়ে শুরু করেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে বড় ব্যবধানে হেরে ছিটকে পড়ে আর্জেন্টিনা। পরে ম্যারাডোনার চুক্তি নবায়ন করেনি আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন। ক্যারিয়ার অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার কনেক্স ফাউন্ডেশন ম্যারাডোনাকে ‘হীরক কনেক্স’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। এটি আর্জেন্টিনার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্মাননা। ২০০০ সালে ফিফার শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় ছাড়াও বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা দলেও জায়গা পান তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে আমেরিকান বাবা ও ক্রোয়েশিয়ান মায়ের সন্তান ম্যারাডোনা ১৯৮৪ সালে ফিয়ান্সি ক্লদিয়া ভিয়াফানিয়েকে বিয়ে করেন। দুই কন্যাসন্তানের বাবা তিনি। এছাড়া তার এক পুত্র প্রাক্তন বান্ধবী ভেরনিকা ওজেদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
একনজরে ম্যারাডোনা পূর্ণ নাম : ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা ফ্রাঙ্কো
জন্ম : ৩০ অক্টোবর, ১৯৬০
জন্ম স্থান : লানুস, বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা
উচ্চতা : ১.৬৫ মি (৫ ফুট ৫ ইঞ্চি)
মাঠে অবস্থান : প্লে-মেকার ক্লাব : আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ।
জাতীয় দল : আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০, আর্জেন্টিনা।

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*