গোপাল সিং, খোয়াই, ১১ জানুয়ারী ।। বৈচিত্রময় এই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের ভীড়ে আজ আমি অবহেলিত এক ভবঘুরে।’ শহুরে চাকচিক্যের মধ্যে এই ভবঘুরে নামটা উত:প্রোতভাবে জুড়ে গেছে। প্রায়শ:ই দেখা যায় এলোমোলো চুল, ছেড়া ছেড়া পোষাক আর একটা মস্ত বড় তল্পি বগলদাবা করে প্রচন্ড ব্যস্ততায় ছুটে যাচ্ছে একদল ভবঘুরে। কাছাকাছি ঘুরাফেরা করলে নাকে রুমাল চাপা দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকেনা। প্রচন্ড দুর্গন্ধ, এলোমেলোভাব ভবঘুরেদের নিজস্বতা। তাই তারা অবহেলা, উপেক্ষার পাত্র হয়ে উঠে। তারা কি জীবনের মুল স্রোতে ফিরতে চায়না? সেই ধারনা করাটাও বড্ড বেমানান হয়ে পড়ে ভবঘুরে এই তকমার কারনে। সেই হিতজ্ঞান হয়তো তাদের নেই। কিন্তু এখানেই কি অফূরন্ত জীবনের সব কিছুই ফুরিয়ে যায়? সত্যিই কি তাদের সামান্য বোধশক্তিও নেই?
অন্তত খোয়াইয়ের সুভাষপার্কে ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী ঘটনা সেই সব ধারনাকে ম্লান করে দিয়েছে বইকি আশা জাগিয়েছে সেই সমস্ত ভবঘুরেদের জন্য যারা পথে-ঘাটে নির্জীব জীবন কাটাচ্ছেন। কারন যাকে নিয়ে আলোচনায় আগ্রসর হওয়া, তার ভাগ্যের চাকা হয়তো বা এবার ঘুরতে যাচ্ছে। সে দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত খোয়াইয়ের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে, সুভাষপার্ক প্রাণকেন্দ্রে, কোহিনুর কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কুকুর আর ভবঘুরে, একটা চরম বন্ধুত্বপনার মধ্যেই শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস একসাথে তারা একে অপরের সঙ্গী হিসাবে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যে যতটুকু আনুমানিক জানা গেছে যে, এই যুবকের নাম কেশব দেবনাথ। বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। সে সম্ভবত কল্যানপুর থানাধীন পশ্চিম ঘিলাতলি দাওছড়া গ্রামের বাসিন্দা। তারা ৩ ভাই ১ বোন। কেশবের যখন আনুমানিক ১৫-১৬ বছর বয়স ছিল তখনই সে বাড়ি ছাড়া। সে ঘটনা ২০০৬ সালের। তারপর থেকে এই ৯ বছর কেশবকে কাটাতে হয়েছে আপনজনদের আদর-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েই। কারন তার খোঁজ হয়নি। প্রশাসন কিংবা কোন সমাজসেবী সংস্থার এবিষয়ে তেমন কোন উৎসাহ নেই। ভবঘুরে তকমা নিয়েই দীর্ঘ ৯ বছর কাটিয়ে দেওয়া কেশব দেবনাথ তাহলে ফিরে কি যাবে আপনঘরে? মায়ের কোলে? ভাইয়েদের আশ্রয়ে? তাহলে তো কতই না আনন্দ!
কিন্তু কিভাবে এই মহামিলন সম্ভব হলো? জানা যায় গত শুক্রবার খোয়াই সুভাষপার্কেরই একটি হোটালে খাবার খাচ্ছিলেন কেশব দেবনাথের বড় ভাই বলে দাবি করা এক ব্যাক্তি। যার নাম শ্যামল দেবনাথ। উনার যখন খাওয়া চলছিল তখনই হোটেলে খাবার চাইতে পৌছায় কেশব (ভবঘুরে)। এমন সময় কেশব তাকে দুর থেকে চিনে ফেলে। ছুটে যায় ভাইয়ের কাছাকাছি। দু’চোখ ভরা জল নিয়েই ভাইকে দেখে সেখান থেকে চলে আসে কেশব। সন্দেহ হয় শ্যামল দেবনাথের (বড় ভাই)। সেও ছুটে যায় অপরিচিত ছেলেটির পেছন পেছন। কোহিনুর কমপ্লেক্সের সামনে কেশবকে বসে থাকতে দেখে ভাল করে তাকিয়ে দেখে শ্যামল। সন্দেহ হয় এই যে ৯ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই। সন্দেহ দুর করতে খোয়াই জাম্বুরা গ্রামে নিজ বোনকে ফোন করে শ্যামল। ছুটে আসে বোন। সেও দেখে অনুমান করে এতো হারিয়ে যাওয়া ভাই কেশব। শুরু হয় তৎপরতা। তারপর যা নাটকীয়কতা তার সবটাই অতিবিচক্ষনতা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
একটি ভবঘুরে। যে কিনা বছরের পর বছর ধরে রৌদ্রতপ্ত দুপুরে হুমড়ি খেয়ে দাবদাহ সহ্য করেছে। তেমনি প্রচন্ড শীতের কাঁপন সহ্য করেছে। তার দিকে এগিয়ে এসে কেউই একটি কম্বল পর্য্ন্ত জড়িয়ে দেয়নি। এত বস্ত্রদান হচ্ছে, সমাজসেবামূলক কর্মসূচী গৃহীত হচ্ছে কিন্তু ভবঘুরেদের গায়ে কেউ একটা বস্ত্র, একটা কম্বল জড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসেনি। তারাই সমাজসেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান হাঁকেন। কি অদ্ভুত ঘটনা! একিনা সভ্য সমাজ। খোয়াই শহর এবং শহরতলির ব্যস্ততম স্থানগুলো, বিশেষ করে নৃপেন চক্রবর্তী এভিন্যু থেকে শুরু করে খোয়াই জেলা হাসপাতালের আনাচে-কানাচে এদের এলোমেলো অবস্থায় প্রায়শ:ই দেখা যায়। ওদের বেখাপ্পা আচরনে নাস্তানাবুদ হতে হয় পথচারীদের। যদি শহুরে স্বেচ্ছা সেবী, সমাজসেবী সংগঠনগুলো কিংবা ক্লাবগুলো এগিয়ে আসতো তবে প্রশাসনিক তৎপরতায় এই ভবঘুরেদের পুনর্বাসন সম্ভব হতো। কিন্তু এনজিও বা ক্লাবগুলোর সেই সময় কোথায়? সভ্য সমাজের কাছে এ এক লজ্জার। ভিখারি নামটা ত্রিপুরা রাজ্য থেকে অতীতের পাতায় বিলুপ্ত হয়েছে কবেই। কিন্তু মাথাচারা দিয়ে উঠেছে ভবঘুরেরা। হয়তো সামান্য চিকিৎসায় সেরে উঠতো তারা। ফিরে যেতে পারতো আপনজনের কাছে। প্রশাসন তৎপর হলে মিডিয়ার প্রচার পেলে বহু ভবঘুরেদেরই হাল ফেরত।
কিন্তু যারা কোনও দিন কেশব নামে ঐ ভবঘুরের খোঁজ পেলেন না, সেদিন কিন্তু সবই ছুটে এলেন। তাতেই স্পষ্ট কেশবের প্রতি তাদের মোহ রয়েছে। নাড়ির টানে সেদিন তাই ছুটে এলেন জন্মদাতা পিতা-মাতারা। এক ঝলক দেখেই তারা চিনে নিলেন ছেলেকে। ভাই, বোন, মাসি সবাই এলেন ছুটে। তারা নিশ্চিত এই যে হারানো কেশব। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে নেন কেশবকে বাড়ী নিয়ে যাবেন। আর নয় দুশ্চিন্তা। কিন্তু বাদ সাধলেন প্রত্যক্ষদর্শী এবং বাজার ব্যবসায়ীরা। উপযুক্ত প্রমান ছাড়া কোনও ভাবেই ওকে নেওয়া যাবেনা বলেই জানিয়ে দেওয়া হয় কেশবের স্বজনদের। তারা ছুটে যান থানায়। থানা বাবুরা যথারীতি উপযুক্ত প্রমান নিয়ে আসতে সমস্তরকম নিয়ম-কানুন জানিয়ে দেন। বৈধ প্রমানের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে কেশবের পরিবার। হারানো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া পেপার কাটিং, পরিচয়পত্র, গ্রাম প্রধানের দেওয়া তথ্য ইত্যাদি থানায় জমা করে তবেই কেশবকে ঘরে তুলতে পারবে তার পরিবার। কিন্তু ঠিক কবে নাগাদ তা কার্যৃত সম্ভব হয় তাই এখন দেখার।
তবে কি এভাবে ভবঘুরেদের সব্বাই আপনজনের কাছে পৌছতে পারেনা? তাদের কি আপনজনদের ভালবাসা পাবার অধিকার নেই? আপনজনরাই বা কি করছেন? কেন তারা এগিয়ে আসছেন না? সবাই মিলে কি এগিয়ে এসে এদের জন্য কিছু করার সাধ হচ্ছেনা? চলুন পথ-ঘাট পরিত্যক্ত স্থান থেকে জীবনের মুল স্রোতে ফিরাই এই সব ভবঘুরেদের। কই চলুন!