



এরপর উদ্বোধক তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রি মানিক সরকার উনার আলোচনা করতে গিয়ে প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেন এবং নব নির্মিত খোয়াই টাউন হলটি স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রয়াত সমীর দেবসরকারের অবদানের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তুলে ধরেন। তবে উনার আলোচনার শুরুতেই সবাইকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই অত্যাধুনিক টাউন হলটি নির্মানের জন্য প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকার এর তৎপরতায় নগরোন্নয়ন দপ্তরের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এর অনুমোদন পাওয়া যায়নি। কিন্তু খোয়াইয়ের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকার ছিলেন নাছোর বান্ধা। তাই তিনি যখন জানলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার এর অনুমোদন দেয়নি তখন প্রয়াত সমীর দেবসরকার ত্রিপুরা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেন। শেষ পর্যন্ত উনার আবেদন বলুন, দাবি বলুন আর চাপ বলুন। সব কিছুর কাছে রাজ্য সরকার আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মাথা নত করে এবং অত্যাধুনিক টাউন হল নির্মানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ প্রয়াত সমীর দেবসরকার ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করেন। বিশেষ করে আগরতলায়। ওখানে যা যা সুযোগ-সুবিধা আছে তার সবক’টি সুবিধা তিনি একে একে খোয়াই টাউন হলের জন্য নিয়ে আসেন। রাজ্য সরকারের অনুদানে অন্যান্য মহকুমার প্রেক্ষাগৃহের তুলনায় অনেক বেশী টাকা খরচ হয়েছে খোয়াই টাউন হলের জন্য। এর কৃতীত্ব নি:সন্দেহে প্রয়াত বিধায়ক সমীর দেবসরকার এর, বললেন মুখ্যমন্ত্রী।
এরপরই মুখ্যমন্ত্রী স্বদলবলে পায়ে হেঁটে চলে আসেন খোয়াই টাউন হলে। সেখানে বোতাম টিপে এর উদ্বোধন করেন এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। প্রদীপ প্রজ্জ্বলেনের সাথে সাথেই টাউন হল মঞ্চে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কমিটির, খোয়াই বিভাগের শিল্পীরা। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠান চলাকালীনই মন্ত্রি মানিক দে সহ অন্যান্য অতিথি এবং আধিকারিকদের নিয়ে গোটা টাউন হলটি পরিদর্শন করেন এবং সোজা চলে যান সিপিআই(এম) খোয়াই জেলা কার্য্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি স্বদলবলে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়না হন। তবে মুখ্যমন্ত্রি যেখানে উনার ভাষনে বললেন, ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে খোয়াই হচ্ছে সংস্কৃতির পীঠস্থান। লেখক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী সব কিছুতেই খোয়াইয়ের এবং রাজ্য ও বহি:রাজ্যে অনেক সুনাম অর্জন করেছে যা আজ সুবর্ণ ইতিহাস। অথচ বাস্তবে দেখা যায় খোয়াই শহরের অনেক নাট্য সংগঠন বা প্রবীন নাট্য ব্যাক্তিত্বরা টাউন হল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রই পায়নি। এনিয়ে বিশেষ একশ্রেনীর নাট্যমোদিরা মর্মাহত।
তবে যাইহোক খোয়াই জেলায় তৈরী হল আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় সমস্ত সাধন যুক্ত অত্যাধুনিক খোয়াই টাউন হল। নব নির্মিত এই টাউন হলের শুভ উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রি মানিক সরকার। তিনি এই নতুন টাউন হলটির উদ্বোধনের আগেও নির্মান কাজ পরিদর্শন এবং তদারকি করেছেন। নানান ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে অভিজ্ঞদের উপদেশ দিয়ে গেছেন। তারপরও নানান সুবিধা, অসুবিধা রয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত খোয়াই টাউন হলের প্রসঙ্গে জনগনের মনে এবং নাট্য ব্যাক্তিত্বদের মুখে একটাই আলোচ্য বিষয়। প্রায় ৫ বছর ধরে কাজ চলার পর এবং আগরতলা থেকেও অনেক কাগজপত্র, অনেক অভিজ্ঞ নাট্য ব্যাক্তিত্বদের এনে কাজ দেখানোর পরও প্রথম কাজেই ভুল ধরা পড়ছে। নব নির্মিত টাউন হলের প্রথম যার প্রয়োজন মানে মঞ্চ তাতেই নানান ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ছে। মঞ্চের উচ্চতা নিয়ে ত্রুটি রয়েছে। বর্তমানে মঞ্চের উচ্চতা রয়েছে আড়াই ফুট। খোয়াইয়ের অবসর প্রাপ্ত এবং যাদের কোন খোঁজ খবর বা সম্মান দেওয়া হয়না নানান কারনে। তাদের মতে মঞ্চ কমপক্ষে ৫ ফুট উঁচু হওয়া উচিত ছিল। এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে। উনারা বলছেন, যিনি মঞ্চে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করবেন তিনি অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে মঞ্চের সামনে বসবেন। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার বন্ধুরাও নানা প্রকার ছবি তোলতে মঞ্চের সামনে যাবেন বা ভিডিও করতে ক্যামেরা স্ট্যান্ড ব্যবহার করবেন। যে কারনে দর্শকের আসনের প্রথম সারিতে দর্শক ও ভিভিআইপিদের বসার জায়গা থেকে অনুষ্ঠান দেখতে বিশেষ অসুবিধা হবে। মঞ্চের পেছনের দিকে অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা যাতায়াত করার রাস্তা অনেক দুরে করা হয়েছে। তাতে শিল্পীদের বিশেষ অসুবিধা হবে। গাড়ী পার্কিং এবং রাস্তা ছোট হওয়াতে সামনে যানজট বিরাট আকার ধারন করবে। তাছাড়া যদি কোন বিপদ দেখা দেয় তবে ভীড় সামলানো দায় হবে। এছাড়াও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেগুলি পরবর্তী সময় ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করবে।
তবে জনগনের প্রশ্ন ৫ বছর ধরে কাজ করে এধরনের সামান্য সামান্য ভুল হবার কথা নয়। ব্যাক্ষা দিতে গিয়ে প্রবীনদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, খোয়াই টাউন হলের ইতিহাস। আজকের নয়, ১৯৩৭ইং সনে তৈরী করা খোয়াই টাউন হলের কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ল। খোয়াইতে নব নির্মিত টাউন হলটির নামাকরনও খোয়াই টাউন হলই করা হয়েছে। ভারতবর্ষের মধ্যে হয়তো অন্য কোথাও এমন নজির নেই। একই শহরে, দু’শ মিটারের মধ্যে দু-দুটি টাউন হল, তাও আবার একই নামে। সে যাইহোক। ১৯৩৭ইং সনে ত্রিপুরার রাজা মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর খোয়াইতে সংস্কৃতির জায়গাটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই খোয়াই মহারাজগঞ্জ বাজার সংলগ্ন হরিমন্দির প্রাঙ্গনে প্রথম খোয়াই টাউন হলটি তৈরী হয়েছিল। টিনের বেড়া দেওয়া প্রথম টাউন হল। বছরে কয়েকবার খাজনা আদায় হতো। বিশেষ সভা করা হতো। বাকি সময় নাটক, যাত্রা ইত্যাদি হতো। যদিও পরবর্তী সময় টাউন হলটি স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে খোয়াই বিদ্যুৎ দপ্তরের পাশে। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রি নৃপেন চক্রবর্তীর উদ্যোগে ত্রিপুরা রাজ্য লটারীর টাকা থেকে তৈরী হয় এই টাউন হলটি।
বর্তমানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বনকর এলাকায় তৈরী হয়েছে অত্যাধুনিক খোয়াই টাউন হলটি। যে স্থানে এই নবনির্মিত টাউন হলটি তৈরী হয়েছে তারও একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও রয়েছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তা জানে না। আজকাল পুরনো ইতিহাস কেউ নাড়াচাড়া দেয়না। নতুন খোয়াই টাউন হলের জায়গাটি ছিল বিচিত্র বিশ্বাস মহাশয়ের। ১৯৫২ সাল নাগাদ এই মাঠে কলকাতার স্বনামধন্য যাত্রা দল নাটক দেখাতে এসেছিল। নবাব সিরাজউদ্দোল্লা যাত্রাপালাটি এই মাঠেই সারা রাতব্যাপী হয়। সম্ভবত প্রবেশ মূল্য ছিল ২৫ পয়সা এবং ৫০ পয়সা। সেই সময় জ্যোতি সিনেমা হলের কর্ণধার সূর্য্য পাল মহাশয় যাত্রাপালা দেখতে আসেন। এত লোকের সমাগম দেখে তিনি মনস্থির করেন যে খোয়াইতে একটি সিনেমা হল হলে সেটি অবশ্যই চলবে। ১৯৫৪ইং সনে খোয়াই বনকর এলাকায় জ্যোতি সিনেমা হল এর উদ্বোধন করেন এবং প্রথম বাংলা ধর্মমূলক সিনেমা রাধাকৃষ্ণ দিয়ে শুরু হয় সিনেমা হলের যাত্রা। কিন্তু যেখানে নবনির্মিত আধুনিক কালচারাল কমপ্লেক্স, খোয়াই টাউন হলটি তৈরী হয়েছে একসময় সেখানে ছিল ডাগ কোম্পানী এবং জুট মিল। সেসময় খোয়াইয়ের সমগ্র এলাকার পাট, তিল, কার্পাসগুলি কৃষকরা নিয়ে আসত এবং খোয়াই বিমান বন্দর দিয়েও রাজ্যের বাইরে যেত। এতো ইতিহাস সম্বলিত খোয়াইয়ের এক একটি স্থান ও তার বর্তমান রূপ। আধুনিকতার ছুঁয়ায় বদলে যাচ্ছে সবই। কিন্তু সেই সাথে ইতিহাসও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। নবীন প্রজন্মের ধরা ছুঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া এসমস্ত উল্লেখযোগ্য ইতিকথা চাপা পড়ে যাচ্ছে অট্টালিকার নীচে। যেমনটা সাংস্কৃতিক মঞ্চের ক্ষেত্রে হচ্ছে। আধুনিক খোয়াই টাউন হলের মঞ্চেও দু’দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত করবে বিভিন্ন শিল্পীরা। ২৩শে ডিসেম্বরের পাশাপাশি ২৪শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ও হবে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। খোয়াইয়ের সংস্কৃতি প্রেমী মানুষজন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো আগামী দিনে অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখতেও যে মুখিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে এদিন খোয়াই টাউন হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনসাধারনের উপস্থিতি ছিল লক্ষনীয়।