আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।। জন্মের টান বলে কথা। শত বিপদ উপেক্ষা করে দুদিনের ঐতিহাসিক কেনিয়া সফর শুরু করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশ সফর করছেন ওবামা। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুর্বপুরুষের দেশে এটি তার প্রথম সফর। নিরাপত্তার কারণে বাবার জন্মভিটা ও কবরে যেতে না পারলেও ওবামার দাদীর আশা ওবামা তার বাবার সমাধি যে কোন উপায়ে হোক পরিদর্শন করবেন। ওবামার সফর নিয়ে আফ্রিকার দেশটিতে বইছে ব্যাপক উন্মাদনা। আনন্দের জোয়ারে ভাসছে পুরো কেনিয়া। পাশাপাশি তারা মুখোমুখি হয়েছে ‘দমবন্ধ’ করা নিরাপত্তা ব্যবস্থার। কেনিয়ার স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় নাইরোবির বিমানবন্দরে অবতরণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’। বিমানবন্দরে ওবামাকে স্বাগত জানান কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওবামার সৎবোন উমা ওবামা। দেশটির বেশীরভাগ সংবাদপত্র সোয়াহিলি ভাষায় শিরোনাম করে ‘কারিবু ওবামা’। যার অর্থ ‘স্বাগতম ওবামা’। কেউ কেউ লেখেন, ‘কেনিয়ান বাবার সন্তান যিনি বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন’। কিসুমুজুড়ে চলছে উৎসব। দোকানে দোকানে বিক্রি হচ্ছে বিশেষ ধরনের টি-শার্ট ও টুপি। লোকজন সেগুলো পরে নেচে-গেয়ে আনন্দ করছেন। কোনো কোনোটিতে লেখা, ‘সিয়ায়া—এই সেই স্থান, যেখান থেকে আমার গল্প শুরু হয়েছে’। আবার কোনোটিতে লেখা, ‘বাবা, আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ি ফিরছি’। কিসুমু-বুসিয়া মহাসড়কের পাশে বিশাল এক বিলবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা, ‘পিতৃগৃহে ওবামাকে স্বাগত’। আফগানিস্তানের চাইতেও ঝুঁকিপূর্ণ সফর অভিহিত করে বিশ্লেষকদের অভিমত, কাবুলে মার্কিন ঘাঁটি আছে। বর্ম হিসেবে তারা থাকতে পারে। কিন্তু আল কায়েদা অনুরাগী সোমালিয়াভিত্তিক সক্রিয় ভয়াবহ জঙ্গীগোষ্ঠী আল শাবাবের আওতায় থাকা ঘনবসতিপূর্ণ কেনিয়া ওবামার জন্য ভীষন ঝুঁকি হয়ে দাড়াতে পারে। দুই সপ্তাহ আগে উত্তরপূর্ব কেনিয়াতে আলশাবাবের জঙ্গী হামলায় ১৪ জন নিহত হয়। এছাড়া গত বছর নাইরোবিতে শপিং মলে ভয়াবহ হামলায় ৬৭ জন নিহত হয়। কেনিয়া সফরে সফরে প্রায় সাত ঘন্টা রাস্তা অথবা ১ ঘন্টা হেলিকপ্টারে কাটাতে হতে পারে। সিক্রেট সার্ভিসের ইচ্ছা কোনভাবেই খোলা জায়গায় যেন প্রেসিডেন্ট একাধারে এক মিনিটের বেশী অবস্থান না করেন। হঠাৎ করে কালিলনিতে কোগালো গ্রামে চলে আসলে সে ব্যবস্থাও করে রেখেছে সিক্রেট সার্ভিস। সেক্ষেত্রে বিদেশী সাংবাদিকদের সেকানে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আসবে। কারণ সেখানে প্রেসিডেন্টকে ভিড়ে রাখার নুন্যতম সম্ভাবনা নেই। ইতিমধ্যে, ওবামার কেনিয়া পৌছানোর সময় দুবার পেছানো হয়। পরে শুক্রবার নির্ধারিত সময়ের পরে এসে নাইরোবিতে নামেন ওবামা। শহরের কেটে বেরিয়ে প্রধাণ মহাসড়ক উহুরু পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা বন্ধ থাকবে শনিবার ওবামার বিদায়ের আগ পর্যন্ত। ওবামা নাইরোবিতে অবতরণের এক ঘন্টা আগেই মার্কিন সৈন্য ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারপাশে অবস্থান নেয়। নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তায়, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাড়ি ফেরার সফর থেকে বাদ পড়েছে পূর্বপুরুষের গ্রাম পরিদর্শন! যেখানে রয়েছে ওবামার বাবার কবর। কেনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইরিয়াম বেলেমির মতে, ৪৮ ঘন্টায় পশ্চিম কেনিয়ার গ্রামটির পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান প্রায় অসম্ভব। আল শাবাবের যে কোন আক্রমনের আওতায় থাকা গ্রামটি কেনিয়া সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রনেও নেই। বেলেমির ভাষ্য, এমনিতে প্রেসিডেন্টের কেনিয়া সফর উচ্চ বিপদমাত্রায় রয়েছে। পূর্বপুরুষের গ্রামে গেলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দুইবার কেনিয়া সফর করেছিলেন বারাক হোসেন ওবামা। সিনেটর থাকাকালে সর্বশেষ সংক্ষিপ্ত সময়ের পারিবারিক পুর্নমিলনীতে যোগ দিয়েছিলেন ওবামা। সে সফরে পশ্চিম কেনিয়ার লেক ভিক্টোরিয়ার নিকটবর্তী গ্রাম কোগালোতে বাবার কবর পরিদর্শন করেন। যদিও অনেক কেনিয়ানের ধারণা, এবারও বাবার গ্রামে আচমকা চলে আসবেন ওবামা। বাবার ভূমিতে যেতে না পারলেও প্রায় ৩৬ জনের পারিবারিক সদস্য হোটেলে ওবামার সাথে দেখা করেন। যার মাঝে সৎ দাদী মামা সারা এবং সৎ বোন অমা ওবামাও ছিলেন। তাদের সাথে রাতের খাবার গ্রহণ করেন আবেগে আক্রান্ত ওবামা। এর আগে ওবামার সৎদাদি সারাহ হোসেন ওবামা গতকাল সকালেই দেশটির কিসুমু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে করে নাইরোবির উদ্দেশে রওনা হন। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওবামার সঙ্গে দেখা করে তার বাবা বারাক হোসেন ওবামা সিনিয়রের সমাধিতে আসার জন্য রাজি করাব। আমি চাই, সে সিয়ায়া কাউন্টির কোগেলো গ্রামে তার বাবার সমাধিতে গিয়ে প্রার্থনা করুক। জানি না তাকে রাজি করাতে পারব কি না। তবে চেষ্টার ত্রুটি রাখব না। এলাকাবাসীও তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন’। কেবল জন্মস্থানে ফেরার প্রসঙ্গ নয় বরং নানা দিক দিয়ে ওবামার প্রথম কেনিয়া সফর গুরুত্বপূর্ণ। সফরকালে প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তার সঙ্গে ওবামার বৈঠক করার কথা। ৫০ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার কেনিয়ায় মার্কিন বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান ও মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করবেন দুই দেশের প্রেসিডেন্ট। কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের ১০০০ লোক হত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা হয়। যদিও গত ডিসেম্বরে মামলাটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু তার ডেপুটি উইলিয়াম রুটোর নামেও একই অপরাধে মামলা চলছে। যিনি এই সফর দেখভালও করছেন। এ নিয়েও বিতর্ক উঠবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। ২০১৩ সালে আফ্রিকা সফরে সেনেগাল, তানজানিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করলেও কেনিয়ায় যেতে পারেননি। তখনই কথা দিয়েছিলেন কেনিয়া সফরে খুব দ্রুত সময়ের মাঝে আসবেন। দুই বছর পরে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন তিনি। সেই সফরে আফ্রিকান দেশগুলোতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা বরাদ্দ হলেও কেনিয়ার ভাগ্যে বরাদ্দ ছিল না। এবার সে হতাশা কাটবে বলে বিশ্বাস কেনিয়ার। পাশাপশি সমলিঙ্গ অধিকার নিয়ে তর্কের মুখে পড়তে পারেন ওবামা। রোববার বিকেলে ওবামা প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়ায় যাবেন। নিরাপত্তার বাধ্যবাধকতায় স্ত্রী-কন্যাদের সফরে আনেননি মার্কিন রাষ্ট্রপতি। ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক সুসান রাইসের মতে, তার সফরের বিপদ নিয়ে আমরা ওয়াকিবহাল। নিজের মত করে সময় কাঁটানো এবং স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ নিরাপত্তা জটিলতায় না মিললেও পিতৃপুরুষের মাটিতে সফর যে ওবামাকে সারা জীবন আন্দোলিত করবে তা বলাই বাহুল্য। সফরে আসার আগে ওবামা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সফরটা প্রেসিডেন্ট হিসেবে না গেলেই আরও অর্থবোধক হত। তাহলে হোটেলে কিংবা কনফারেন্স সেন্টার কেন্দ্রিক হতোনা সফরটি। সুত্র: পলিটিকো, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি