লাকড়ি বিক্রেতাদের লড়াকু জীবন কাহিনী

khowaiগোপাল সিং, খোয়াই, ০২ ডিসেম্বর ৷৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পর কেমন আছেন বর্তমান খোয়াই জেলার লাকড়ি বিক্রেতারা? যারা শহর থেকে ১৫-২০-৩০ কিমি দূর থেকে ‘ভার সিক্কা’ অর্থ্যাৎ কাঁধে করে নিয়ে আসতেন লাকড়ির ভার। যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে লাকড়ির ভার একসময় কাঁধ থেকে নেমে পড়ে বাই-সাইকেলে। এই মেহনতী মানুষদের কাছে কখনও মিডিয়া পৌছেনা। কিংবা ক্যামেরার ফ্ল্যাস পড়েনা ঘর্মাক্ত শরীরে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা সেইসব রক্তে মাংসে গড়া মানুষগুলোর দিকে। লাকড়ি বিক্রেতাদের নিয়ে দু-চার অক্ষর কোন লেখক-কবি’র মস্তিস্কে ঘর করে না। কোন সামাজিক সংস্থা, এনজিও বা কোন রাজনৈতিক দলের স্বপ্ন দেখানো নেতা-কর্মীরাও পৌছেন না তাদের কাছে। অথচ একসময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাজার-হাঁট করে বাড়ী ফিরলে গৃহিনীদের প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল লাকড়ির। তবে লাকড়ি হতে হবে শুকনো। নতুবা রান্না ভাল হবে না। গৃহিনীর কথা শুনতে হবে উপরন্তু ধোঁয়ায় ভরে উঠবে ঘর। এসব এখন কেমন যেন কাহিনী কাহিনী বলেই মনে হয়।
কিন্তু কাহিনীর মুল চরিত্ররা কিন্তু এখনও সেই পথেরই পথিক। এখনও খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেনী বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে মুল রাস্তার ধারে রৌদ-বৃষ্টি উপক্ষো করে বসে থাকতে দেখা যায় সারিবদ্ধ লাকড়ি বিক্রেতাদের। যদিও লাকড়ি বিক্রেতাদের করুন কাহিনী শুনবার অবকাশ খুব কম মানুষের কাছেই আছে। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, রাজার আমলে তৈরী খোয়াই মহারাজগঞ্জ বাজারে (বর্তমান পুরান বাজার) মহিলারা দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় করে আর পুরুষরা কাঁধে করে লাকড়ি নিয়ে আসতেন। মাথায় করে আনা বোঝা বিক্রি হতো ৫০-৬০ পয়সা আর ভাড় বিক্রি হতো ১টাকা থেকে তার বেশী। এই লাকড়ি বিক্রি করে কোন প্রকার বাজার-হাঁট করে গ্রামে ফিরতেন তারা। তৎকালীন সময়ে ছিল ফরেষ্ট এর জুলুম। প্রতিদিন লাকড়ি বিক্রেতাদের (ট্যাক্স) দিতে হত। প্রতি লাকড়ি বিক্রেতা ২৫ পয়সা। অথচ কোন সময় ৫০ পয়সার লাকড়িও বিক্রি করতে পারতেন না লাকড়ি বিক্রেতারা। সেই কারনে অনেক সময় লাকড়ি বিক্রেতাদের দ্বারা ফরেষ্টার বাবুদের নিগৃহীত হতে হয়েছে। তৎকালীন নবোদয় বিদ্যালয়ের কাছে বর্তমান সময়ে মুন্ডা বস্তি এলাকায় ছড়ার ভেতর ফরেষ্টারকে মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে তখনকার সময়ে সিআইডিকে লাগানো হয়। পরে তদন্তক্রমে আসামী জগন্নাথ মুন্ডাকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ঘটনার ১৫ দিন পর ফরেষ্টারের দেহ ও খুনের জন্য ব্যবহৃত কুড়ালটি মিলে। এমন বহু ঘটনার সাক্ষী লাকড়ি বিক্রেতারা।
শহরমুখী হয়েও এদের অনেককেই অপমান সহ্য করতে হয়েছে দিনের পর দিন। বর্তমানেও হচ্ছে। ফরেষ্টারের জুলুম, লেবির বিরুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্যব্যাপী আন্দোলন হয়েছিল। গরীব-শ্রমিক-মেহনতি মানুষদের পুঁজি করে সব রাজনৈতিক দলগুলো কম বেশী ক্ষমতা দখলের স্বাদ পেয়ে যাচ্ছেন বা যাবেন। কিন্তু উনারা ভুলে গেলেন সেই গরীব-শ্রমিক-মেহনতী মানুষগুলোর কথা। যেমন লাকড়ি বিক্রেতা, ক্ষেতমজুর, রিক্সা শ্রমিক, গাড়ী চালক, দোকান কর্মচারী, জুতো কারবারী, বাদ্যকর সহ নানাহ শ্রমিকগুলো আজ দিশেহারা।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আজ অবধি লাকড়ি বিক্রেতাদের ঘরের ৯৮ শতাংশ ছেলে-মেয়েরাই মাধ্যমিকের গন্ডী টপকাতে পারেনি। স্বভাবতই জুটেনি কোন সরকারী চাকুরী। বেশ কিছু বিপিএল কার্ড থেকেও বঞ্চিত। সরকারী সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৭০ বছরেও এই সমস্ত লাকড়ি বিক্রেতারা শহরের বাজারে বসার কোন সরকারীভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। আজ এখানে তো কাল ওখানে। দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এদের। যদিও রিক্সা চালকরাও কোন নির্দিষ্ট করে সরকারী স্থান পায়নি। ১৯৭৮ইং বামফ্রন্টের খোয়াইয়ের প্রথম বিধায়ক কামিনী সিংহ মহাশয় চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন এবং বর্তমানে শ্রীকৃষ্ণ মন্দির স্থলেই স্থান করে দিয়েছিলেন রিক্সা চালকদের জন্য। একটি শেড ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময় কিছু ভোটের জন্য রিক্সা শ্রমিকদের রৌদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থরিট কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকে আজ অবধি আর কোন জায়গা পাননি রিক্সা চালকরা। একই প্রকার খোয়াই জেলায় লাকড়ি বিক্রেতাদের জন্যও কোন নির্দিষ্ট স্থান হয়নি। অথচ এই পেশায় উপজাতি, হিন্দুস্তানী সম্প্রদায়ের মানুষই বেশী।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি শুধু জনসভা, পথসভায় গরীব-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কথা বলে। বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্য কথাই বলছে। তাই সময় ফুরিয়ে যাবার আগে এদের দিকেও তাকাতে হবে। নয়তো পাহাড় ভাঙলে, শহর ভাঙতে কতক্ষন !

FacebookTwitterGoogle+Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*