গোপাল সিং, খোয়াই, ০২ অক্টোবর || সীতারাম ইয়েচুরির গুণাবলীকে আহরণ করতে হবে। তার জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে শিক্ষিত হতে হবে। সীতারামের জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কসবাদ লেনিনবাদের চর্চাকে আরো পরিব্যাপ্ত করতে হবে। প্রসারিত করতে হবে। বলেছেন সিপিআই(এম)’র পলিটব্যুরোর সদস্যা মানিক সরকার। বুধবার খোয়াইয়ে প্রয়াত নেতার শপথদৃপ্ত স্মরণসভায় তিনি বক্তব্য রাখছিলেন।
সিপিআই(এম)’র খোয়াই মহকুমা কমিটির আহ্বানে সাড়া জাগানো উদ্দীপ্ত স্মরণসভাটি হয় স্থানীয় শিক্ষক ভবনের হল ঘরে।” শোককে শপথে পরিণত করো” এই আহ্বান জানিয়ে আয়োজিত স্মরণসভায় মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলের পার্টির সর্বস্তরের নেতা, কর্মী, দরদী ও সমর্থক জাতি উপজাতির মানুষজন উপস্থিত ছিলেন। উপচে পড়া জনভীড়ে আয়োজিত স্মরণসভায় হলের ভেতরে সবার স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অনেকেই হল ঘরের বাইরে, বারান্দায় ও লনে বসে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শোনেন।
স্মরণসভায় পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য মানিক সরকার ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঘোর দেববর্মা ও মহকুমা সম্পাদক পদ্ম কুমার দেববর্মা। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক রঞ্জিত দেববর্মা সহ জেলা ও মহকুমা কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন রাজ্য কমিটির সদস্য নির্মল বিশ্বাস। সভাপতি ছিলেন মহকুমা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আলয় রায়। প্রয়াত নেতাকে উপস্থিত সবাই মৌনশ্রদ্বায় স্মরণ করেন।
শুরুতেই সীতারাম ইয়েচুরির প্রতিকৃতিতে ফুলে ফুলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মানিক সরকার, অঘোর দেববর্মা ছাড়াও নেতৃবৃন্দ। শিল্পী শেলী চক্রবর্তী পরিবেশন করেন ” তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম” গানটি।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মানিক সরকার বলেন, সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন এক ব্যাতিক্রমী নেতা। মেধাবী ছাত্র ও বহুমুখী বিরল গুণের অধিকারী। ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির নেতা। জে এন ইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র।ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সভাপতি। তার নেতৃত্বেই তখনকার সময়ে জে এন ইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী শক্তির পদচারণা শুরু হয়। যা আজকেও বিদ্যমান। সীতারাম ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকেই অন্য ধাতুতে গড়া। বক্তৃতা দিয়ে সভা ছেড়ে চলে আসার লোক ছিলেন না তিনি। এলাকায় ঘুরতেন। কথা বলতেন সব অংশের মানুষের সাথে।যে কোন বিষয়ে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করতেন।উত্তরণের পথ খুঁজতেন। যে কোন বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনুশীলন করতেন। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণ আন্দোলনকে বিকশিত করার চেষ্টা করতেন। এই যে মানুষের সাথে সহকর্মীদের সাথে সহযোদ্বাদের সাথে মেলামেশা করে সবটা বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া তা আজকে আমাদের অনেকের মধ্যেই নেই। তাই সীতারামের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নেতা কর্মীদের বিভিন্ন দুর্বলতা থেকে মুক্ত হতে হবে।
মানিক সরকার বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে তিনি তখন থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিকল্প নেই। উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে মার্কসবাদ লেনিনবাদী পথই হচ্ছে সঠিক দিক নির্দেশনা। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ সহ শোষণ ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা, পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার বিশ্লেষণ করতেন তিনি। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন তিনি। না বুঝে, না অনুভব করে কোন কিছুকে বিশ্বাস করার লোক ছিলেন না তিনি।পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের অবসান করে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। যার মূল ভিত্তি ছিল মার্কসবাদ লেনিনবাদ।
মানিক সরকার বলেন, মার্কসবাদ লেনিনবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও রাজ্য পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতেন। যে কোন জটিল পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণ করতেন। তার জীবন ছিল লেনিনের জীবনের শিক্ষায় শিক্ষিত। মার্কসবাদ লেনিনবাদের শিক্ষাকে ভিত্তি করে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন। মার্কস অ্যাঙ্গেলস লেনিনের লেখাগুলো পড়তেন বারবার।গোটা বিষয়বস্তুকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন।হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতেন। এটা করতে পেরেছেন বলেই সীতারাম ইয়েচুরি যথার্থ অর্থেই সীতারাম ইয়েচুরি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।সীতারাম বুঝেছিলেন যে, মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথ ধরে জীবনের পথে এগিয়ে চললে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। ওলটপালট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মানিক সরকার বলেন, মার্কসবাদী লেনিনবাদী সাহিত্য বইপত্র অধ্যয়ন করতেন নিয়মিত। এসব মার্কসবাদী লেনিনবাদী সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে ত্রিপুরায়ও জননেতা নৃপেন চক্রবর্তী, দশরথ দেব, বীরেন দত্তরা গুরুত্ব দিয়েছেন। পার্টির পত্রিকা ও সাহিত্য বইপত্র বিক্রী করেছেন। সভা জমায়েত মিছিলের কর্মসূচীতে গিয়ে পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহ করেছেন। বিশেষ করে জি এম পি গড়ার সময়ে উপজাতি কর্মীদেরকে এভাবেই শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেছেন তারা। এভাবেই জনচেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন। আজকে তারই ধারাবাহিকতায় আমাদেরকে মার্কসবাদী লেনিনবাদী প্রগতিশীল সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। পত্র পত্রিকা অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আত্মস্থ করতে হবে গভীরভাবে। তাহলেই চেতনার পরিব্যাপ্তি ঘটানো সম্ভব। নিজেকেও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। একইসাথে শ্রেণী সংগ্রাম। এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিক গণ আন্দোলনকে বিকশিত করা। আর গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতম অংশের মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা মানুষকে লড়াই ময়দানে সম্পৃক্ত করা। এই হলো প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়ার সাথেই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। তার জীবন থেকে আমাদেরকে এই শিক্ষাই নিতে হবে। তার লিখিত গ্রন্থাবলীর মধ্যেই তার জীবনের আত্মোপলব্ধির কথা তিনি বিধৃত করে গেছেন। যা আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক।
তিনি বলেন, সীতারামের গোটা জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের। বাস্তবের সাথে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। মার্কস লেনিনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। গভীরভাবে অনুশীলন করতে হবে। মার্কসবাদ লেনিনবাদের চর্চা বাড়াতে হবে।অনুশীলন করতে হবে।
তিনি বলেন, সীতারামের গোটা জীবন ও সংগ্রামই মার্কসবাদী লেনিনবাদী শিক্ষায় সমৃদ্ধ। সাংসদ হিসেবেও তিনি কোন ধরনের সঙ্কীর্ণতায় ভুগতেন না। সব অংশের মানুষের স্বার্থে কথা বলতেন সংসদে। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে কথা বলতেন।কিন্তু প্রতিপক্ষের সাংসদেরাও সংসদে সীতারামের বক্তব্য শুনতেন। সারা বিশ্বের দৃষ্টি তিনি আকর্ষণ করতে পারতেন। তার লক্ষ্য ছিল মানুষের ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলা। প্রতিপক্ষের সাংসদেরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সীতারাম কোন সাধারণ সাংসদ নন। আজকে আমাদের সাংসদদেরকেও সীতারামের সংসদীয় জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তার জীবনশৈলী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে। অপর দলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দক্ষ নেতা। এক্ষেত্রে তিনি প্রয়াত নেতা হরকিষেণ সিং সুরজিতের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন। অন্য দলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হলো একটা শিল্প। এটা একটি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার অন্যতম মূল কাণ্ডারি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সীতারাম।
তিনি বলেন, রাজ্যে গণতন্ত্র আক্রান্ত ।ভোটাধিকার নেই মানুষের। বন্যা দুর্গতদের জন্য কোন ত্রাণ সহায়তা নেই। মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় ৪৬৫ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করছেন। অন্যদিকে দুর্গত মানুষকে ত্রাণ শিবির থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে। প্যাকেজ বলে যা বলা হচ্ছে সেটা তো এমনিতেই রাজ্যের প্রাপ্য। বন্যা না হলেও তো তা রাজ্যে আসার কথা। রাজ্যে নারীদের ওপর অপরাধ ক্রমবর্ধমান। দ্রব্যমূল্যের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। আইন শৃঙ্খলা বিপর্য্যস্ত। জীবন জীবিকা আক্রান্ত। কাজ নেই। দেশেই তো চাকুরি নেই। বন্যায় মানুষ সহায় সম্পদ হারিয়েছে। কিন্তু সরকার অমানবিক।এখন পর্য্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এক পয়সাও দেয়নি কেন্দ্র। উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে।রেগা টুয়েপের কাজ নেই। কাজ দিলেও মজুরি মিলছে না। এই অরাজকতার বিরুদ্ধে দুর্বার লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
স্মরণসভায় অঘোর দেববর্মা বলেন, সীতারাম ইয়েচুরি চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার জীবন ও সংগ্রামের এক গৌরবদীপ্ত ইতিহাস।সেটাই আমাদের এখন আগামী লড়াই সংগ্রামের দিক নির্দেশ। তিনি মার্কসবাদী লেনিনবাদী আদর্শে বলীয়ান ছিলেন। নিজেকে ছাত্রাবস্থা থেকেই তৈরি করেছিলেন। গোটা পার্টিটাকে নিজের পরিবারের মতো ভাবতেন। মতাদর্শগত অবস্থানে সুদৃঢ় ছিলেন তিনি। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আন্দোলনকে আরো ক্ষুরধার করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে নব্বইয়ের দশকে মার্কসবাদের বিপর্য্যয়ের সময়েও সীতারাম বলেছিলেন যে, মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান। মার্কসবাদ অজেয়। তার কোন মৃত্যু নেই। এটা অভ্রান্ত। প্রয়োগের ত্রুটির জন্য এটা সাময়িক বিপর্য্যয় মাত্র। আজকের আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী থেকে সীতারামের কথার যথার্থতা প্রমাণিত।
স্মরণসভায় পদ্ম কুমার দেববর্মা বলেন, সীতারামের জীবন ও সংগ্রাম আমাদের কাছে সারা জীবনের পাথেয়। আমাদের জন্য আগামী দিনের দিক নির্দেশনা। তার জীবন ও সংগ্রাম অনুসরণ করা যায়। কিন্তু অনুকরণ করা যাবেনা।
স্মরণসভার সভাপতি আলয় রায় বলেন, স্মরণসভা শুধু প্রয়াত নেতার ছবিতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নয়। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করার শপথ গ্রহণের প্রক্রিয়া হলো স্মরণসভা।সাহস সঞ্চয় করে ভয়কে জয় করে আমাদের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে হবে।